দেশে প্রচুর অনলাইন শপ গড়ে উঠেছে। এটি খুবই ভালো। উদ্যোক্তার জন্য ভালো, ক্রেতার জন্য ভালো, দেশের জন্যও ভালো। তবে এ ব্যাপারে আমি কিছু বলতে চাই। যদিও আমি ব্যবসায়ী নই, তবু এ বিষয়ে বলার কিছুটা যোগ্যতা আমার আছে বলে ধারণা। কারণ আমাদের অনলাইন চ্যারেটি শপ ‘অনেস্ট’ এর প্রত্যক্ষ সদস্য ৩২ হাজার, আর তাঁদের মাধ্যমে যুক্ত আছেন আরো প্রায় বিশ হাজার পরোক্ষ সদস্য। মানে মোট বায়ান্ন হাজার সদস্য নিয়মিত অনেস্ট থেকে কেনাকাটা করেন। এরা একজনও ইনঅ্যাক্টিভ নন। আমার জানামতে এদেশে আর কোনো অনলাইন শপের এতো বেশি হাইপারএকটিভ সদস্য নেই। এরা ফেইসবুকে লাইক/কমেন্টের অ্যাকটিভ নন, কাজে অ্য্যাকটিভ। সবাই নিয়মিত অনেস্ট থেকেই কিনেন।গড়ে প্রতি ছয় মিনিটে আমাদের একটি পণ্য বিক্রি হয়। মাত্র তিন বছরে এত বড়ো একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার অভিজ্ঞতা আমরা যদি শেয়ার করি তা বোধহয় সীমা অতিক্রম করবে না।এগুলো হলো;১. ঠকাবেন না।অনলাইন ব্যবসায় ভালো করার এক নম্বর শর্ত হচ্ছে, দয়া করে ক্রেতাকে ঠকাবেন না। পণ্যের প্রকৃত বর্ণনা দিন। আসল ছবি আপলোড করুন। ফটোশপে এডিট করা ছবি নয়। যাতে তিনি তিনি হাতে পাওয়ার পর আপসেট না হন। মার্কেট রিসার্চের জন্য আমি অনলাইনে প্রায় জিনিস কিনি এবং দেখি অনলাইন বর্ণনার সাথে তা মিলে না। এটা হলে দ্বিতীয়বার কোনো ক্রেতা তো যাবেনই না, বরং আরো দশজনকে বলে দেবেন যাতে না যান।গত তিন বছরে অনেস্ট কিন্তু একটি অভিযোগও পায়নি।২. দায়িত্ব নিন।আপনার পণ্যের দায়িত্ব আপনাকেই নিতে হবে। কোনো কারণে তা ক্রেতার পছন্দ না হলে তাঁকে দায়ী না করে বলুন ‘আমি খুব দুঃখিত, আপনার প্রোডাক্টটি পছন্দ হয়নি। তার মানে আপনার চাহিদা আমি পূরণ করতে পারেননি। দয়া করে ওটি ফেরত দিন। আমি পুরো টাকা ফেরত দিচ্ছি।”ফেরত আনার খরচও আপনাকেই বহন করতে হবে। এটাই ব্যবসার নৈতিকতা। অনেস্ট এটা করে।৩. বি অথেনটিক। যা বলছেন তাই করবেন। সস্তা চায়নিজ জিনিস আপলোড করে বলবেন না, দুনিয়ার সেরা জিনিস এটি। কদিন আগে দেখলাম, একটি অনলাইন শপ ২৫০০ টাকায় গুচি ব্যাগ বিক্রি করছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এটা কি আসল গুচি? নির্বিকার উত্তর আসলো, হ্যাঁ, স্যার।আমি তখন গুচির ওয়েবসাইট থেকে একই ব্যাগের লিংক পাঠিয়ে বললাম, আসল ব্যাগের দাম এক লক্ষ টাকার উপরে। আপনার কীভাবে তা আড়াই হাজার টাকায় দিচ্ছেন?কোনো জবাব নেই। আমার কমেন্ট রিমুভ করা হলো। ব্লক করা হলো।সো, প্লিজ বি অথেনটিক। ৪. দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বেশির ভাগ অনলাইন ব্যবসা মুখ থুবড়ে পড়ে, কারণ তারা রাতারাতি ধনী হতে চান। দুনিয়ার কোনো ব্যবসা আলাদিনের প্রদীপ নয় যে আমার গলির ভাঙা বাড়িকে একরাতে প্রাসাদ বানিয়ে দিতে পারে। অনলাইন বিজনেসও তা পারে না। তাই কয়েক বছরের পরিকল্পনা করুন। বছর অনুযায়ী তা সাজান। যেমন অনেস্টে আমাদের মাসওয়ারি প্ল্যান আছে। আমরা তাতে সফলও হয়েছি।৫. মার্কেট রিসার্চ। একই পণ্য বাজারে অন্যরা কত দামে ছাড়ছে তা নিয়ে রিসার্চ করুন। তারপর তাদের চে পাঁচ টাকা কমে হলেও আপনার পণ্য ছাড়ুন। দাম তুলনা করলে যাতে আপনি জিতে যান। মনে রাখবেন ক্রেতা কিন্তু আরো কয়েকটি অনলাইন শপ দেখে সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে একবার যদি বুঝে ফেলেন যে, আপনার পণ্যের দাম অন্যদের চাইতে কম, তাহলে তিনি পরেরবার আর ঘুরাঘুরি করবেন না।আপনার কাছেই আসবেন।৬. কর্মীদের ন্যায্য পাওনা দিন।কর্মীদের অবশ্যই ন্যায্য পাওনা দিন। মনে রাখবেন বঞ্চিত মন নিয়ে একজন কর্মী কখনোই মন দিয়ে কাজ করবেন না। আমাদের প্রতিষ্ঠান অনেস্ট করোনাকালেও কর্মীদের পাঁচ শতাংশ বেতন বাড়িয়েছে এবং সম্প্রতি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে যারা আছেন তাঁদের শেয়ার দেওয়ারও সিদ্ধান্ত হয়েছে।৮. গ্রাহক স্বার্থ।দয়া করে গ্রাহকদের মায়া করুন। সব সময় তাঁদের স্বার্থ প্রাধান্য দিন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে এতে আপনার লস হবে। আসলে হবে না। মায়ার বন্ধনে জড়ালে তাঁরা সারাজীবন আপনার সাথে থাকবেন৷ আরো দশজন ক্রেতা টানবেন। করোনার সময় ‘অনেস্ট’ কিন্তু তাঁর বিপন্ন শত শত ক্রেতাকে অফেরতযোগ্য আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। আমরা মনে রেখেছিলাম, এরাই আমাদের এ পর্যায়ে এনেছেন, তাহলে তাঁদের বিপদে সে ঋণ আমাদের শোধ করতে হবে। এছাড়া অনেস্টের লাভের ৬০% কিন্তু ক্রেতারা পান এবং প্রতিটি বিক্রির সাথে সাথে তা দিয়ে দেওয়া হয়। কোনো ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ নেই। ক্রেতাদের লাভের মেজর শেয়ার দুনিয়ার আর কোনো প্রতিষ্ঠান দিয়েছে বলে অন্তত আমি জানি না। শিগগিরই আমরা আমাদের সদস্যদের জন্য ‘চিকিৎসা সুরক্ষা প্রকল্প’ চালু করবো, যার মাধ্যমে আমাদের কোনো সদস্য অসুস্থ হলে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ চিকিৎসা খরচ ‘অনেস্ট’ বহন করবে।৯. নট লাইভ, বাট লাভ।শুধু শুধু লাইভ টাইভ করে ফালতু জিনিস গছিয়ে ওয়ান টাইম ব্যবসা করবেন না। করলে ব্যবসায় তালা ঝুলাতে বেশি সময় লাগবে না। মার্কেট অ্যানালাইসিস করে আমার মনে হয়েছে, যারা এসব করেন, ক্রেতারা তাঁদের তেমন বিশ্বাস করেন না। কথা হচ্ছে ‘চেনা বামুনের পৈতা লাগে না।’বরং ভালবেসে ব্যবসা করুন। কাজটিকে ভালবাসুন, ক্রেতাদের ভালোবাসুন, কর্মীদের ভালোবাসুন। ব্যবসার সাথে মায়া মেশান, দেখুন সোনা ফলবে।১০. নেভার বি ওভারস্মার্ট।বেশিরভাগ ব্যবসা গোল্লায় যায় নিজেকে ওভারস্মার্ট আর ক্রেতাদের বেকুব ভাবার কারণে।সবসময় তিনিই সফল হন, যিনি অন্যকে নিজের চে স্মার্ট ভেবে সেভাবেই তৈরি হন। আপনি ক্রেতাকে বোকা ভাবলেন তো জলের তলায় ডুবলেন। কেউ বোকা নন, তাই এটা ভেবে পয়সা কামানোর চিন্তা বাদ দিন। ধরে নিন দুনিয়ার সবচে স্মার্ট লোকটির কাছে আপনার পণ্য যাচ্ছে, তিনি সন্তুষ্ট হবেন তো? ১১. স্মার্ট কর্মী নিন।নিজের ওভার স্মার্ট হওয়া যাবে না, কিন্তু কর্মী নিতে হবে স্মার্ট। তাঁদের কাছ থেকে আপনিও শিখবেন।১২. অগ্রীম নেবেন না।অনেস্ট অগ্রীম এক টাকাও নেয় না।ক্রেতা হাতে পেয়ে পছন্দ হলে টাকা পে করেন। নয়তো করেন না।প্রশ্ন হচ্ছে, নিজেরা অনলাইন শপ চালিয়ে সিক্রেটগুলো বলছি কেন?উত্তর হচ্ছে, যেকোনো অভিজ্ঞতা শেয়ার করা নৈতিক দায়িত্ব। তাতে যদি একজনও উপকার পান, সেটাই অনেক বড়ো। জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা নিজের মগজে বন্দী রেখে কবরে নিয়ে যাওয়া একধরনের অপরাধ।
(তবে অনেস্ট চ্যারেটি প্রতিষ্ঠান। ক্রেতাদের ৬০% লাভ দিয়ে বাকি ৪০% চ্যারেটিতে খরচ করা হয়। উদ্যোক্তারা একটাকা লাভও নেন না। তাই সবাই অনেস্টের মতো পারবেন না, কিন্তু ব্যাসিক নিয়মগুলো ফলো করা যায়। আর দয়া করে অন্য কারো কাছ থেকে কিনে ঠকলে সেটা ক্লিয়ার করবেন। যদি কমেন্ট করেন ‘একবার ঠকেছি’ অনেকেই ভাববেন অনেস্ট ঠকিয়েছে।)
সর্বশেষ – একজন ক্রেতা Honesty online shop থেকে কিনে Honest কে দায়ী করেছেন। আশা করি নাম গুলিয়ে ফেলবেন না। এ দুটো এক প্রতিষ্ঠান নয়। ক্লিয়ার করার জন্য কমেন্টে অনেস্টের লিংক দিলাম।