আই অ্যাম আ রোড সাইড এমবিএ!

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্টাডি আপনাকে যা শেখাবে, তারচে কম শেখাবে না চারপাশের অভিজ্ঞতা। ব্যাপারটি নিয়ে অনেকদিন ধরে ভাবছিলাম৷ পরে দেখলাম এ চিন্তাটির সাথে ভারতের বিখ্যাত কর্পোরেট গুরু এবং সাবেক সেনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন রাগু রমনের মতামত কাকতালীয়ভাবে প্রায় হুবহু মিলে গেছে! তিনি একে বলছেন ‘রোড সাইড এমবিএ’।
আমি তাঁর সাথে একমত। তাই তাঁর এবং আমার চিন্তা মিলিয়ে নিচের লেখাটি লেখলাম।
১। সেলস বা বিক্রি নিয়ে বড়ো বড়ো মাল্টিন্যাশনালগুলো কত মাথা ঘামাচ্ছে! কত ট্রেইনিং, কত গবেষণা, আরো কত কী? কিন্তু আমার তো মনে হয় সবচে ভালো ‘সেলস” ট্রেইনিং দিতে পারেন একজন বীমা কোম্পানীর এজেন্ট, তিনিই একমাত্র সেলসম্যান যিনি মৃত্যুর মতো ভয়ংকর কিন্তু অনিবার্য একটি সত্যকে ব্যবহার করে এইমাত্র একটা পলিসি করিয়ে নিলেন। তাঁর মতো ভবিষ্যত বিপদকে মার্কেটিং টুল বানাতে আর কেউ পারবেন? তাই কীভাবে ‘বিক্রি’ করতে হয় তা শিখতে হলে আমি একজন বীমা কর্মীর কাছেই তা শিখবো। হি নোজ দি আর্ট দ্যা বেস্ট। আমি তাঁকে শ্রদ্ধা করি।
২। রাস্তায় যে বাচ্চারা ভ্যালেন্টাইনের সময় গোলাপ বিক্রি করে, তারাই বর্ষায় বিক্রি করে কদম ফুল, আবার এরাই বিভিন্ন জাতীয় দিবসে সেখানে জাতীয় পতাকা বিক্রি করে। সময় বুঝে প্রোডাক্ট লাইন পরিবর্তনের এত দ্রুত সিদ্ধান্ত কি বড়ো বড়ো কর্পোরেট বডিগুলো নিতে পারেন?
না, পারেন না। গবেষণা করতেই তাঁদের কয়েক বছর লেগে যায়, আর আমাদের এ বাচ্চারা তা করে ফেলে কোনো গবেষণা ছাড়াই- এবং কখনোই তাঁরা ব্যর্থ হয় না। কখন প্রোডাক্ট লাইন বদলাতে হবে তা শেখার জন্য এরা হচ্ছে সবচে আদর্শ গুরু।
৩। সকালে হাঁটতে বের হলে দেখি, এক লোক মর্নিং ওয়াকারদের দশ টাকা নিয়ে ব্লাড সুগার মেপে দিচ্ছেন, সাথে দেখি ব্লাড প্রেসার মাপছেন ফ্রি। তার মানে এ অতি সাধারণ ব্লাড সুগার মাপার লোকটি তাঁর ব্যবসার ফিফটি পার্সেন্ট সিএসআর বা ব্যবসার সামাজিক দায়বদ্ধতা বাবদ খরচ করছেন। বড়ো বড়ো মাল্টিন্যাশনালের পাঁচ পার্সেন্ট সিএসআরের সিদ্ধান্ত নিতে কতবার যে তাদের পরিচালনা বোর্ডের সিদ্ধান্ত নিতে হয় ইয়ত্তা নেই। অথচ মুহূর্তের সিদ্ধান্তে রাস্তার পাশে ডায়াবেটিস মাপার মেশিন হাতে বসে থাকা লোকটি সম্ভবত দুনিয়ার সবচে বেশি পরিমাণ আয়ের অংশ সিএসআরের পেছনে খরচ করছেন!
তাঁর কোনো মিটিং-সিটিংয়ের দরকার হয়নি।
৪. আশ্চর্যজনকভাবে ক্যাপ্টেন রাগু রমনের সাথে আমার একটি পর্যবেক্ষণ মিলে গেছে। তাহলো, কয়েকমাস আগে একটি লাইভ ইন্টারভিউতে আমাকে অদ্ভুত এক প্রশ্ন করা হলো, তা হচ্ছে রাস্তায় ট্রাফিক জ্যামে গাড়ির কাছে এসে হকাররা যদি আপনার বই বিক্রি করে কেমন লাগবে? আমি উত্তর দিলাম, দেখুন রাস্তায় যিনি বই বিক্রি করেন, তাঁর মূলধন অতি সামান্য, আবার খুব বেশি বইয়ের ভার বইবার শারিরীক ক্ষমতা তাঁর নেই, তাই তিনি অতি ক্ষুদ্র মূলধন নিয়ে শীর্ণ শরীরে সে-ই দশ/বারোটি বই বিক্রি করার জন্য বাছাই করেন যেগুলো অবশ্যই বিক্রি হবে। প্রায় নিরক্ষর হকারটিই আমাকে বুঝতে শেখান কোন বইটি বেস্ট সেলার। তাঁর হাতে কারো বই উঠা মানে সে বইটি অতি সফল। ইটস আ সিউর শট। তাই আমি অপেক্ষা করছি কোনদিন তাঁদের হাতে আমার বই দেখবো।
৫৷ চাহিদা নিয়ে, কাস্টমার কী চাইছেন তা নিয়ে আমরা কত গবেষণা করি, কিন্তু আমার পাড়ার রফিক ভাই সকালে স্কুলের সামনে চকোলেট, আমড়া, পেয়ারা এগুলো বিক্রি করেন, আর সন্ধ্যায় পাড়ার রকে যেখানে ছেলেপুলেরা আড্ডা দেয়, সেখানে বিক্রি করেন পেঁয়াজ আর কাঁচা মরিচসহ ছোলা ভাজা। মুহূর্তে প্লেটের পর প্লেট উড়ে যায়৷ তাহলে আমাদের কাস্টমার ডিমান্ড কী তা শিখতে হবে রফিক ভাইয়ের কাছে।
৬। একইভাবে আমার অফিসের সামনে প্রতিদিন সকালে একটি ভ্যানে জব্বার ভাই গরম গরম পরোটা ভাজেন, পাশেই আরেকটি ভ্যানে কুদ্দুস ভাই বানান গরম চা। লোকজন দেখি জব্বার ভাই থেকে পরোটা কিনে তা কুদ্দুস ভাইয়ের চায়ে ডুবিয়ে আরাম করে খাচ্ছেন। একদিন জব্বার ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই, আপনি নিজে চা বানান না কেন? এতে বিক্রি বাড়তো না? চা এবং পরোটা দুটো আইটেম?
জব্বার ভাই উত্তর দিলেন, কুদ্দুইসার হাতে চা হয় ভালো, আমি তার মতো বানাইতে পারতাম না। পুরা চায়ের টাকাই মাটিত যাইবো। তাই হে চা বানাক, আমি পরোটা। তাতে দুইজনেরই লাভ, এইডা ভালা না?
এ ভালোটা বুঝে দুনিয়ার বড়ো বড়ো মাল্টিন্যাশনালগুলো অন্যের সাথে কোলাবোরেশান করতে বছরের পর বছর কাটিয়ে দেয়, আর আমাদের জব্বার আর কুদ্দুস ভাই চট্টগ্রাম শহরের এক কোণায় পরোটা আর চায়ের কোলাবোরেশান করেছেন কত সহজে?
ব্যাপারটা শেখার মতো না?
৭। আবার দেখুন, সব বড়ো বড়ো বেকারিতে লেখা ‘উই বেইক আওয়ার ব্রেড ডেইলি’- আমরা প্রতিদিন তাজা রুটি বানাই।
কাস্টমার টানার জন্য এ শ্লোগান কতো গবেষণা করে বের করা হয়েছে! আর উপরে বর্ণিত জব্বার ভাই রাস্তার ধারে তাজা রুটি বানাচ্ছেন ত্রিশ বছর ধরে! এর গুরুত্ব বোঝার জন্য তাঁকে বড়ো বড়ো ডিগ্রি নিতে হয়নি।
এটাই হচ্ছে ‘রোড সাইড এমবিএ’।
জব্বার ভাই কিংবা কুদ্দুস ভাইদের এ ইনফরমাল অর্থনীতি কিন্তু বাংলাদেশের জিডিপিতে ৪৩% অবদান রাখে এবং এ ইনফরমাল সেক্টরই দেশের ৮৮% পার্সেন্ট কর্মসংস্থান করে। তাই এ রোড সাইড এমবিএদের অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই।
তাই আমাকে যখন প্রশ্ন করা হয়, এই যে আপনারা একটির পর একটি নন প্রফিট প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন, তা আপনি কোত্থেকে এমবিএ করেছেন?
আমি হেসে উত্তর দেই, ‘ফ্রম দ্যা রোড সাইড।’
(১.পাদটীকা: এ পোস্টের অর্থ কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি দরকার নেই তা বলা নয়, বরং এটা বলা যে, আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে চারপাশ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে যা বই-পুস্তকে পাওয়া যাবে না। তবে তা কখনই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিকল্প হতে পারে না।
২. আগ্রহীরা Captain Raghu Raman কে ইউটিউবে ফলো করতে পারেন। হি ইজ জাস্ট অ্যামেইজিং!

আসুনমায়াছড়াই

(লেখাটি শেয়ার করা যাবে।)