এভাবেই ফিরিয়ে দেওয়ার পালা আসে।
মাস দুয়েক আগে একজন সহকর্মী এসে ইতস্তত করতে লাগলেন।আমি কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললাম, “যা বলার বলে ফেলো। ডোন্ট ওয়াস্ট টাইম, প্লিজ।”সে সাহস পেয়ে বললো, স্যার, আমাদের এক স্টাফ ভারতে চিকিৎসা করাতে গিয়ে করোনার কারণে আটকা পড়েছেন। সঙ্গে যা টাকাপয়সা নিয়েছিলেন তা প্রায় শেষ। তাই গুরুতর বিপদে পড়েছেন। কখন আসতে পারবেন তা বুঝতে পারছেন না। তাই অনুরোধ করেছেন যদি পারি কিছু টাকা পাঠাতে।৷ তিনি এসে শোধ করবেন।”আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তা কী করতে চাও?””আপনি অনুমতি দিলে আমরা সবাই মিলে ব্যবস্থা করবো।””কীভাবে পাঠাবে? দেশের বাইরে টাকা পাঠানোতে তো ঝামেলা আছে।”” স্যার, আমার একজন পরিচিত ভদ্রলোকের ভারতে ব্যবসা আছে। উনি ওখানকার অফিসে বলে দিলে ওরা দিয়ে দেবে। আমরা তাঁকে এখানে পেমেন্ট করবো। বাংলাদেশ থেকে টাকাটা অবৈধভাবে যাবে না স্যার।””ঠিক আছে, চলো কাজটা করি। করা উচিত। মেইক মি পার্ট অব ইট।”এরপর টাকাটা পাঠানোর ব্যবস্থা করে ব্যাপারটা ভুলে গেলাম।কয়েকদিন আগে একই অফিসার আবার আসলেন, বললেন, “স্যার, ওই ভদ্রলোক ইন্ডিয়া থেকে থেকে ফেরত এসেছেন। আপনার সাথে দেখা করতে চান।””কোন ভদ্রলোক?”” স্যার, যার জন্য টাকা পাঠিয়েছিলাম।””ও আচ্ছা, আসতে বলো।” ভদ্রলোক আসার পর জিজ্ঞেস করলাম,”এখন আপনার শরীর ভালো?”তিনি আমতা আমতা করে বললেন, “স্যার,আমি না, আমার স্ত্রী অসুস্থ ছিলেন।””কী হয়েছিলো বলা যাবে?””স্যার, দীর্ঘদিন আমাদের কোনো ইস্যু হচ্ছিলো না। দেশে অনেক চিকিৎসা করিয়েও ফল না পেয়ে ইন্ডিয়া গিয়েছিলাম। সি ইজ প্র্যাগন্যান্ট নাউ স্যার”- বলে ভদ্রলোক ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন।এবার আমি থমকে গেলাম। স্তম্ভিত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিনি আমাকে এক ধাক্কায় ২০০৪/৫ সালে ঠেলে দিয়েছেন। একই সমস্যায় আমরাও ছিলাম।সিদ্ধান্ত নিলাম ব্যাংকক যাবো। কিন্তু টাকা নেই। জীবনে যা করিনি তাই করা শুরু করলাম। ধার চাওয়া।আহা! কত স্বজন, বন্ধু যে এগিয়ে এসেছিলেন। বাপ্পি ভাই অনেকদিনের জমানো এফ ডি আর ভেঙ্গে বাসায় এলেন। রেজা স্যার একদিন অফিসের সিঁড়ির গোড়ায় ডেকে নিয়ে হাতে কিছু টাকা দিয়ে ‘পরে ফেরত দিও’ বলে তরতর করে উপরে উঠে গেলেন। আব্বু একদিন গোপনে তাঁর মেয়ের হাতে তুলে দিলেন সঞ্চয়ের বড়ো একটি অংশ। আব্বা রিটায়ার করেছেন দুই যুগ আগে। তিনি পেনশনের বাঁচানো টাকা কখন যে আমার বই এর টেবিলে রেখে গেছেন বুঝতেও পারিনি।আলি আহমদ ভাই একদিন অফিসে একটি চেক ধরিয়ে দিয়ে বললেন, এটা রাখেন। এক সময় ফেরত দিলেই চলবে। আহা! এরকম কতো মানুষ। মাত্র কয়েক বছরের চাকুরির অনেক কষ্টে বাঁচানো সঞ্চয় মানিম ‘ভুলে’ বাসায় ফেলে রেখে চলে গেলো। ফেরত দিতে গেলে গম্ভীর কন্ঠে বললো, “ব্যাংকক থেকে ঘুরে আয়। তারপর নিবো। আমার বাসাটা নিরাপদ না, তাই তোর কাছে রাখছি। আবার ধার ভেবে বসিস না, গাধা।সব ভাইবোন, নাজিম ভাই, পিয়া খালা, শফিক খালু, মানিক দুলাভাই এর মমতা মাখানো সাহায্য নিয়ে আমার সন্তান লাভের যুদ্ধযাত্রা শুরু হয়েছিল।প্রায় পনের বছর পর, আমার সেই আরাধ্য রাজকন্যা যেদিন ষোলোতে পা দিলো, সেদিনই ভদ্রলোক মনে করিয়ে দিলেন, যা আমরা নেই, তা আমাদের আবার ফিরিয়ে দিতে হয়। ‘ধার’ এর যে মমতা আমি পেয়েছিলাম, নিজের অজান্তেই আমার কাছ থেকে প্রকৃতি তা ফেরত নিয়েছে। আমার বন্ধুদের সহায়তায় আরেকজনের একই সংগ্রামের জন্য টাকা জোগাড় করিয়ে! আমাকে জুড়ে নিয়েছে আরেকটি অনাগত শিশুকে পৃথিবীর আলো দেখানোর যুদ্ধে!আমি নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে আছি, ভদ্রলোকের দিকে তাকাচ্ছি না।অফিসের বড়ো কর্তাদের নাকি চোখের জল দেখানোর নিয়ম নেই।