বাদল সৈয়দ - Badal Syed

করোনা ও তার পরবর্তীতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা যেভাবে ভালো করবেন

করোনা ও এর পরবর্তীতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা টিকে থাকবেন কি না তা নিয়ে অনেকের সন্দেহ আছে। আমি বিশেষজ্ঞ না, কিন্তু ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে মনে করি, এসময় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা শুধু টিকে থাকবেন না, ভালো করবেন। দেয়ার ইজ আ সিলভার লাইনিং। শুধু বুদ্ধি করে এগুতে হবে।

১. প্রফিট কম রাখুন।
বড় বড় দোকান বা সুপার শপের অতিরিক্ত মুনাফালোভী চরিত্রের কারণে ক্রেতারা তাঁদের ওপর চরম বিরক্ত। এটাকে পুঁজি করুন। আপনি চলার মতো লাভ রেখে বিক্রি করুন, দেখবেন আপনার কাছেই সবাই আসবে। লাভ কম রাখা খুবই সম্ভব, কারণ আপনার এস্টাবলিশমেন্ট খরচ এদের চাইতে কম।
মনে রাখবেন, এ দুঃসময়ে এক টাকা বাঁচাতেও লোকজন এক দোকান থেকে আরেক দোকানে যাবেন। এ সুযোগটা আপনার নিতে হবে।

২. বেশি বিক্রি, কম লাভ।
প্রান্তিক লাভ রাখুন, বিক্রি বাড়ান। দিনশেষে দেখবেন আপনার লাভ কম হচ্ছে, বরং বেশি হচ্ছে।। লাভ কম রাখলে বিক্রি বাড়বেই। বিক্রি বাড়লে আলটিমেটলি লাভ বাড়বে- এটা সরল সত্য।

৩. পাড়ার ক্রেতাদের নিজের দিকে টানুন।
এটা অন্যতম প্রধান সূত্র। আপনার লক্ষ্য থাকবে পাড়ার লোকজন। তাঁরা একজনও যাতে আপনার দোকান ছেড়ে অন্য জায়গায় না যান। তাই তাঁদের যা দরকার তা স্টকে রাখুন, কম দামে দিন। শুধু পাড়ার লোকেরাই আপনার ব্যবসায় স্বর্ণ ফলাবে। আর কারো হেল্প লাগবে না। মনে রাখবেন,আজকের আমেরিকার কেনেডি ফ্যামিলির যে বিশাল ব্যবসা সাম্রাজ্য, তা গড়ে উঠেছিলো ১৮৫০ এর দশকে ‘ব্রিগিট’ নামে এক পূর্বসূরির হাত ধরে। এ অকাল বিধবা আয়ারল্যান্ড থেকে এসে ছোট্ট একটি মুদি দোকান দিয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন পাড়ার আইরিশ কমিউনিটিকে তিনি আর কোনো দোকানে যেতে দেবেন না। সেই মুদি দোকান থেকে যে পরিবারটির উত্থান তা আমেরিকায় একজন প্রেসিডেন্ট, চারজন সিনেটের, একজন অ্যাটর্নি জেনারেল ও কয়েকজন রাষ্ট্রদুতের জন্ম দিয়েছে। সেদেশের ব্যবসার বড় একটি টুকরো এখনো তাঁদের পাতে।

৪. ঠকানোকে না বলুন।
লোক ঠকিয়ে একদিন ব্যবসা করা যায়। প্রতিদিন নয়। তাই প্রতিজ্ঞা করুন একটি লোককেও ঠকাবেন না। আপনার সততার কথা যখন ছড়াবে, তখন ক্রেতাকে জায়গা দিয়ে কুল পাবেন না।

৫. নগদ বিক্রি।
সব সময় চেষ্টা করুন নগদ বিক্রি করতে। খুব।বিশ্বস্ত ক্রেতা না হলে বাকিতে না দেয়াই ভালো। বাকির টাকা ফেরত না পেলে লাভের বড় অংশ গোল্লায় যাবে।

৬. ছোট থেকে শুরু।
প্রথমেই বেশি ইনভেস্ট করবেন না। প্রথমে অল্প দিয়ে শুরু করুন, ধীরে ধীরে তা বাড়ান। তাহলে লস হলেও ধাক্কা সামলাতে পারবেন।

৭. হাসুন।
প্রত্যেক ক্রেতার সাথে হেসে কথা বলুন। সুযোগ থাকলে বসতে দিন। হাসিমুখের যাদু ব্যবসায় অনেক বড় ভূমিকা রাখে।

৮. হোম ডেলিভারি।
হোম ডেলিভারি দেওয়ার ব্যবস্থা রাখুন। যাতে ফোন করলেই প্রয়োজনীয় পণ্য বাড়ি পৌঁছে দিতে পারেন।

৯. ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তোলা।
প্রত্যেক ক্রেতার সাথে একটি ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তুলুন। তিনি যদি একবার আপনাকে সুখ-দুঃখের সাথী ভাবতে শুরু করেন, তাহলে কখনো আপনাকে ছেড়ে যাবেন না।

১০. ঋণ করে ব্যবসা নয়।
সম্ভব হলে সুদযুক্ত ঋণ না নিয়ে নিজের টাকায় ব্যবসা করুন।
সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করলে লাভের গুড় পিপড়া খায়।

১১. খরচ কমান।
পারতপক্ষে ব্যবসায় বেদরকারি খরচ করবেন না। অতিরিক্ত সাজসজ্জা/ দামি চেয়ার-টেবিল এগুলোর প্রয়োজন নেই।
আপনার দরকার সিম্পল কিন্তু আন্তরিক একটি ব্যবসায়িক পরিবেশ গড়ে তোলা।

১২. ভালো সাপ্লাই চেইন তৈরি করা।
খুঁজে পেতে মালামাল কিনবার জন্য ভালো উৎস বের করুন।
যেখান থেকে অন্যদের চাইতে কম দামে মালামাল সংগ্রহ করতে পারবেন। তবে পণ্যের মানের সাথে আপোষ করা যাবে না। বাকিতে কিনলে সাপ্লাইয়ারের টাকা দ্রুত পরিশোধ করুন। তাহলে তাঁরা আপনারা আরো বেশি পণ্য বাকিতে দেবেন। এর মানে হলো, আপনি বিনা বিনিয়োগে বেশি বিক্রয়ের সুযোগ পাচ্ছেন।

১৩. হিসাব রাখুন।
ব্যবসাতে একটাকাও লাখ টাকা।৷ তাই প্রতিটি পাইপয়সার হিসাব রাখতে হবে। এ ব্যাপারে কোনো অনিয়ম সহ্য করা যাবে না।

১৪. ক্রেতাদের ডাটা সংরক্ষণ করুন।
সমস্ত ক্রেতাদের তথ্য সংরক্ষণ করুন। কেউ বড় বিরতি দিলে জিজ্ঞেস করুন কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না?

১৫. ফেরত নিন।
আপনার ওপর ক্রেতাদের আস্থা বাড়াতে এটি সবচে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তাঁরা যখন জানবেন, যে পণ্য খারাপ হলে আপনি ফেরত নেবেন, তখন দুটো ব্যাপার কাজ করবে
ক. পণ্যটি নিশ্চয় খারাপ না। যদি খারাপ হতো তা আপনি ফেরত নেয়ার নিশ্চয়তা দিতেন না
খ. পণ্য যেহেতু ফেরত নেয়া হবে তাই তা কিনে ঠকার সম্ভাবনা নেই।
সবচে’ বড় কথা হলো, ঠকাঠকির বাজারে আপনার এ বৈশিষ্ট্যের খবর বিদ্যুৎ গতিতে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বে, যা অসংখ্য ক্রেতা তৈরি করবে।

১৬. পরিশ্রম।
আপনাকে হাঁড় ভাঙা খাটুনি খাটতে হবে। এতে এস্টাবলিশমেন্ট খরচ অনেক কমবে। প্রচুর সময় দিন। অড টাইমে পারলে ব্যবসা খোলক রাখুন বা টেলিফোনে অর্ডার নিন। ক্রেতারা যদি জানেন, আপনাকে সে সময়ও পাওয়া যাবে যখন অন্যদের পাওয়া যায় না, তাহলে তাঁরা আপনার ওপর বেশি নির্ভর করবেন।

১৭. কর্মীদের খুশি রাখুন।
মনে রাখবেন, সন্তুষ্ট কর্মীর চাইতে বড় সম্পদ খুব কম আছে।
কর্মীদের খুশি রাখুন, সুখ-দুঃখে তাঁদের পাশে থাকুন, দেখবেন তাঁরা কাজ দিয়ে তা অনেক গুনে পুষিয়ে দেবেন।

১৯. ছোট ব্যবসা বলে কিছু নেই।
এটা মাথায় রাখতে হবে যে, ছোট ব্যবসা বলে কিছু নেই।
আমি ‘মাস্টার ডিগ্রি ‘ করেছি, আমি কেন মুদি দোকান করবো, ফার্মেসি করবো- এ জাতীয় চিন্তা বাদ দিন। মাস্টার ডিগ্রি করে
অন্যের অফিসে কলম চষার চেয়ে স্বাধীন ব্যবসা অনেক ভালো।
চাকুরি আপনাকে একটা নির্দিষ্ট সীমার বাইরে ‘ভবিষ্যত’ দেবে না, কিন্তু ব্যবসা উপহার দেবে অসীম সম্ভাবনা।

২০. মানবিক হোন।
দয়া করে শুধু ‘ব্যবসায়ী হবেন না, ‘মানবিক ব্যবসায়ী’হোন। লাভের জন্য ব্যস্ত ব্যবসায়ীদের ওপর মানুষ শুধু বিরক্ত না ক্ষিপ্তও বটে। এ সময় আপনার মধ্যে যদি তাঁরা মানবিকতার ছোঁয়া দেখতে পান, বিশ্বাস করুন এ ক্রেতারা আপনাকে মাথায় তুলে রাখবে এবং নিজেদের স্বার্থেই নিচে পড়তে দেবে নক।

২১. ওয়ার্ড অব মাউথ।
মনে রাখবেন ওয়ার্ড অব মাউথের চেয়ে বড় কোনো বিজ্ঞাপন নেই। আপনি যখন সৎভাবে, কম মুনাফায় ব্যবসা করবেন তখন লোকজনই আপনার কথা বলবে। এটাই আপনার ক্রেতা সৃষ্টি করবে সবচে বেশি। মানুষের প্রশংসা যেকোনো ব্যবসার সবচে বড় সম্পদ, আবার একবার বদনাম হয়ে গেলে সে গর্ত৷ থেকে উঠে আসা প্রায় অসম্ভব।

করোনা বা এর পরে যে আর্থিক দুর্যোগ আসবে, তাতে ঠিক ব্যবসায়ী না, বন্ধুর মতো মানুষের পাশে দাঁড়ান। উচিত দামে সঠিক জিনিষটি তাঁদের হাতে তুলে দিন। এমন একটি অনুভুতি তাঁদের মধ্যে তৈরি করুন, তাঁরা যাতে আপনাকে শুভাকাঙ্ক্ষী ভাবেন, কেবল ব্যবসায়ী নয়। দেখবেন আপনার ব্যবসা হু হু করে বাড়ছে, দৌঁড়াচ্ছে ঘন্টায় কয়েশো মাইল বেগে।
কারণ আপনি ঠিক ব্যবসায়ী না, আপনি হচ্ছেন আপনার গ্রাহকদের বন্ধু। পরম মমতায় যিনি তাঁদের কাঁধে হাত রাখেন।

এমন বন্ধুকে ছেড়ে ক্রেতারা আর কোথাও যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না।

#আসুনমায়াছড়াই