১৯৮৫ সাল।
আব্বা সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলেন।তাঁর হাতে ঢাউশ একটি বই।আমি আগ্রহ নিয়ে দেখি ‘রিডার্স ডাইজেস্ট’ এর একটি ঢাউশ গল্প সংকলন।কঠিন ইংরেজি। পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম।আব্বা দেখি মনোযোগ দিয়ে পড়েন।পড়া শেষ হলে জিজ্ঞেস করলাম,’ আব্বা, বইটা কেমন?”
“অসাধারণ বাদলা বেটা। তবে একটা আফসোস রয়ে গেলো।” “কী আফসোস আব্বা?””বইটার নাম দ্যাখ, ‘Fireside Reader’- এ বই পড়তে হয় নির্জন কোনো রুমে। তীব্র শীতের রাতে। ফায়ার প্লেসের পাশে আরাম চেয়ারে বসে। কোমর পর্যন্ত ঢাকা থাকবে পাতলা কম্বলে। পাশে ছোট্ট টেবিলে জ্বলবে ল্যাম্প, সেখানে থাকবে গরম কফির পেয়ালা। সবচে ভালো হয়, বাড়িটা যদি খুব নিরিবিলি কোনো জায়গায় হয়।আফসোস, এরকম পরিবেশে বইটা পড়ার সুযোগ আমার কখনোই হবে না।”
২০১০ সাল।
লিজা তখন একটি আন্তর্জাতিক ফ্রেইট ফরোয়ার্ড সংস্থার (FANA) সদস্য। একই সাথে ওর এম ডি, আমার কাজিন রায়হান সম্ভবত ওটার ভাইস চেয়ারম্যান। প্রতি বছর ওদের মিটিং হয় বিশ্বের বিভিন্ন শহরে। সে বছর তা হবে প্যারিসে। এ শহরটার প্রতি আমার আজন্ম আসক্তি৷ তাই সিদ্ধান্ত নিলাম ওদের সঙ্গী হবো। ওরা মিটিং করবে, আমি ঘুরে বেড়াবো।ব্যবসায়ীরা হচ্ছে ‘ম্যানি ইন ওয়ান’- তাঁরা একটি কাজে বাইরে গেলে আরো দশটা ব্যবসার কাজ সেরে আসেন।অতএব রায়হান আর লিজাও ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় আরো কয়েকটি মিটিংয়ের ব্যবস্থা করে ফেললো।এর মধ্যে একটি ফ্রান্সের লিয়ন শহরে।ছোট্ট একটি অপূর্ব শহর। তারচে অপূর্ব একটি দোতলা হোটেলে আমরা উঠলাম। লিয়ন এমনিতেই নির্জন, আর হোটেলটি হচ্ছে নির্জনতর। জঙ্গলের মধ্যে একাকী রূপকথার দুর্গের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তবে দুর্গটি আকারে মোটেও বড়ো নয়।মোটে আটটি রুম, তবে খুবই এক্সক্লুসিভ। আমরা যখন পৌঁছালাম তখন সেপ্টেম্বরের সূর্য বিদায় নিচ্ছে। বেশ ঠান্ডায় চারিদিকের গাছে ম্লান ভাব, তারপরও বেশ কিছু লাল নীল বেগুনি ফুল বেশ তেজ নিয়ে পুরো এলাকা রাঙিয়ে রেখেছে। সবচে বেশি আলো ছড়াচ্ছে রিশেপসনের ফরাসী সুন্দরী। তাকে দেখে অতি সবল হার্টের অধিকারীরও জ্ঞান হারাবার সম্ভাবনা প্রবল। সন্ধ্যার মধ্যে ডিনার শেষে আমরা যার যার রুমে গেলাম। লিজাদের ভোর পাঁচটায় মিটিংয়ের উদ্দেশ্যে বেরুতে হবে, তাই ঘুমানো দরকার। কিন্তু আমার ঘুম আসছে না। রাত এগারোটার দিকে বের হয়ে ডাইনিংয়ের দিকে গেলাম। সন্ধ্যায় দেখেছি ওখানে ফ্রি কফি মেশিন আছে। গেস্টদের সার্ভ করার জন্য। ভাবলাম একা কিছুক্ষণ বসি। রুমের বাইরে আসতেই ঠান্ডা ঝাপ্টা দিলো। দ্রুত হেঁটে ডাইনিংয়ে এসে অবাক বিষ্ময়ে থমকে দাঁড়ালাম। নির্জন একাকী রুমটির এক কোণে ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলছে। তার পাশে কয়েকটি ইজি চেয়ার।সেগুলোর হাতলে যত্ন করে রাখা কম্বল, যাতে যিনি বসবেন তিনি শরীর ঢেকে উষ্ণতা নিতে পারেন। সামনের টেবিলে জ্বলছে মৃদু আলোর ল্যাম্প। চেয়ারের পেছনে মাঝারি সাইজের র্যাকে বই।একপাশে সাজানো কফি মেশিন, পেয়ালা, প্লেটে বিস্কিট।আমার মাথা ঘুরে উঠলো। আব্বা ঠিক পঁচিশ বছর আগে এরকম একটি পরিবেশে বই পড়ার কী আকুলতাই না প্রকাশ করেছিলেন!’ফায়ারসাইড রিডিং!!’আমি কফির পেয়ালা হাতে ইজি চেয়ারে বসলাম। কোমর পর্যন্ত কম্বল টেনে নিলাম।তারপর পেছন ফিরে র্যাক থেকে বের করলাম একটি বই। হাতে উঠে এলো ‘The Day of the Jackal’ ফরাসি পটভূমিকায় লেখা Frederick Forsyth এর বিখ্যাত থ্রিলার।কিন্তু আমার সেদিকে নজর নেই।ফোর্সিথ পড়ে রইলেন কোলের উপর।গরম কফি ধীরে ঠান্ডা হয়ে সুগন্ধ হারাচ্ছে।আমি সব ভুলে ডাকতে লাগলাম, “আব্বা, আব্বা, আবা।”#আসুনমায়াছড়াইছবি: আব্বার সেই বইটি।