কেন আমি আমার বাচ্চাকে ‘গ্যাজেট’ দেব না—-

আমি অবশ্যই স্টিভ জবস বা বিল গেটসের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান না।
তাঁরা যদি তাঁদের বাচ্চাদের নিজেদের আবিষ্কৃত ‘গ্যাজেট’ ব্যবহার করতে না দেন, আমি দেব কেন??
এরা তাঁদের বাচ্চাদের এগুলো দিচ্ছেন না মানে বাচ্চাদের জন্য তা উপযুক্ত নয়।
ভেরি সিম্পল ইকুয়েশন!!
আমার আর কোনো কিছু বোঝার দরকার নেই ।
অনেকেই বলবেন, এখন তো বাচ্চাদের ইন্টারনেটে অনেক কিছু করতে হয়—-
আমি হাত বাড়িয়ে বলছি, প্লিজ থামুন।
হ্যাঁ, বাচ্চাদের দরকার আছে। কিন্তু তা স্মার্ট ফোন বা ট্যাবে নয়। তারা দরকারি কাজ করবে ডেস্কটপে। এমনকি ল্যাপটপেও নয়, এবং তারা তা করবে রুমের দরোজা খুলে, বন্ধ করে নয়।
আমার অভিজ্ঞতা বলে, বাচ্চার ঘরের দরোজায় খিল দেয়া অ্যালাউ করা মানে তার ভবিষ্যতের দরোজায়ও খিল দিয়ে দেয়া।
আপনি যদি বাংলাদেশের সব মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে যান, শতভাগ, আবার বলছি, শতভাগ কেইস পাবেন, যেখানে বাচ্চারা খিল দেওয়া দরোজার ওপারে সময় কাটাতো।
বাচ্চার প্রাইভেসি?
ব্যক্তিগতভাবে তার শিক্ষাজীবন শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি তার প্রাইভেসির ‘গুল্লি’ মারার পক্ষে।
ছাত্র জীবনে বিশ বছর প্রাইভেসি বিসর্জন দিয়ে সে বাকী ষাট-সত্তর বছর ‘রাজকীয়’ প্রাইভেট জীবন কাটাবে এটাই আমি চাই।
তাই গুল্লি মারি তার প্রাইভেসির।
এবার আসি, কেন আমি কেন তাকে ‘গ্যাজেট’ দেবো না।
সিম্পল উত্তর-এর নির্মাতারাই দেননি, আমি কেন দেবো?
তারা কি আমার চে কম বুঝেন?
এছাড়াও কিছু উত্তর আছে—
১। ট্যাব বা স্মার্ট ফোনে আসলে গেইম খেলা আর ফেইসবুকিং, চ্যাট, ইনস্টাগ্রাম ছাড়া আর কিছুই বাচ্চারা করেনা। আপনি কারো হাত থেকে এ দুটো বস্তু নিয়ে পরীক্ষা করে দেখুন। যদি এর হিস্টরি বলে যে, গত ছয়মাসে একবারও তা শিক্ষার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে, বাঙ্গালীর খাস ভাষায় বলি, তাহলে আমি ‘কান কেটে কুত্তারে খাওয়াবো।‘
২। আরো ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে—আপনি দেখবেন এগুলোর ‘ইতিহাসে’ আরো খারাপ কিছু দেখার কথাও লেখা আছে। ইন্টারনেটের মতো ভালো আবার একই সাথে খারাপ শিক্ষক আর কেউ নেই।
৩। শুধু গেইম খেললে একটা কথা ছিল। এখন এক ধরণের লাইভ গেইম চালু হয়েছে। বাংলাদেশে একজন খেলছে, আমেরিকায় তার প্রতিপক্ষ। বাংলাদেশের ছেলে/মেয়ে খেলছে রাতে, আমেরিকায় যেহেতু তখন দিন, তাই সেখানকার খেলোয়ার খেলছে দিনে। তার মানে ঘুমের বারোটা বাজছে আমার ছেলেমেয়ের। এ বারোটা শেষ পর্যন্ত তাঁর স্কুল/কলেজের তেরোটা বাজায়। পড়াশুনার চৌদ্দটা বাজায়। বন্ধ দরোজার ওপারে গ্যাজেট কিন্তু এ চৌদ্দটাই বাজাচ্ছে।
অতএব, বাচ্চার দরোজায়, নো খিল, নেভার খিল।
৪। আমাদের ছেলে-মেয়েদের হাতের তালুতে ইন্টানেটের উপস্থিতির কারণে তাদের সাথে আমাদের মানসিক দুরত্ব কতটুকু হচ্ছে একবার ভাবুন। মনে করুন তো, শেষ কখন সে আপনার সাথে মোবাইলে চোখ রাখা ছাড়া মনোযোগ দিয়ে কথা বলেছে?? আপনি বলছেন, সে আপনার দিকে না তাকিয়ে মোবাইল টেপাটেপি করে তা অর্ধেক শুনছে,—তা কি হচ্ছে না?
তার মানে তার চোখের দিকে তাকিয়ে আপনার কথা বলার অধিকার কেড়ে নিচ্ছে এই সব গ্যাজেট। আপনি তা হতে দেবেন কেন?
৫। আপনি কি খেয়াল করেছেন, অতিরিক্ত ইন্টারনেট আসক্তির জন্য আমাদের বাচ্চার মধ্যে এক ধরণের ‘ডুয়েল পার্সোনালিটি’ তৈরি হচ্ছে? সে একদিকে বাংলাদেশি আবার অন্যদিকে আমেরিকান কিংবা ব্রিটিশ। তার বাস্তব পারিপার্শ্বিক খাঁটি বাংলাদেশি আর ভার্চুয়াল পারিপার্শ্বিক পশ্চিমা। এটা তার মনে তীব্র দ্বন্ধ তৈরি করছে। যা তার মনোজগতে তীব্র প্রভাব ফেলছে। দেশের কিছুই তার ভাল লাগছে না। এটা থেকে জন্ম নিচ্ছে হতাশা।
“আর হতাশা হচ্ছে ভবিষ্যৎনাশিনী।“
কথাটা আমরা সবাই যাতে মনে রাখি।
আমাদের দেশে একটা প্রবাদ আছে, ‘দুধ বেচে মদ কেনা।‘
আমার ক্ষমতা থাকলে আমি আরেকটি প্রবাদ চালু করতাম তাহলো—-
‘রক্ত বেচে গ্যাজেট কেনা’—কারণ গ্যাজেট কেনার টাকা জোগাড় করতে আমাদের রক্তই তো পানি করতে হয়।
তাই এটা রক্ত বেচে গ্যাজেট কেনার সমান।
আমাদের ভাবতে হবে, রক্ত বেচা টাকায় আমরা বাচ্চাকে ধ্বংস করে দিচ্ছি নাতো??
আমার কথা পরিষ্কার, বাবা হিসেবে আমি গণতান্ত্রিক না। আমার অভিজ্ঞতা বলে ‘গণতান্ত্রিক মা-বাবারা’ সফল মা-বাবা হন না।
আমি ‘লী কুয়ান’ টাইপ বাবা হতে চাই।
যিনি সিঙ্গাপুরকে ‘ফার্স্ট ওয়ার্ল্ডে’ নেবার জন্য ভীষন কর্তৃত্ববাদী ছিলেন।
আমি আমার সকল বাচ্চাকে ‘ সিঙ্গাপুর’ বানাতে চাই। চলমান মনুষ্য সিঙ্গাপুর।
এটা আমদের করতেই হবে।
কারণ সন্তান যদি মা-বাবাকে উচ্চতায় ছাড়িয়ে না যায় তবে সে পিতৃ বা মাতৃ জীবন বৃথা।
আসলেই বৃথা।

আসুনমায়াছড়াই

(লেখাটি শেয়ার করা যাবে।)
©Badal Syed