খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে।বাদল সৈয়দ।আজমল সাহেবের দিনটা শুরু হয়েছিল খুব ভালোভাবে।ফজরের নামাজের সময় ঘুম থেকে উঠেছেন। নামাজ পড়ে বারান্দায় বসেছেন, এমন সময় কোত্থেকে একটি টিয়া পাখি পেয়ারা গাছে উড়ে এসে বসল। তিনি বেশ অবাক হলেন। এর আগে কোনো দিন গাছটিতে পাখি বসতে দেখেননি। ঢাকা শহরে এটি একটি বিরল দৃশ্য। তার মনটা ভালো হয়ে গেল। মনে হচ্ছিলো এটি কোনো শুভ চিহ্ন, আজ তাঁর এ চিহ্নের খুব দরকার ছিল। কাল সারারাত তাঁর ঘুম হয়নি। নানা চিন্তা মাথায় ভর করেছিল। করাটাই স্বাভাবিক। আজ যার একমাত্র মেয়ের বিয়ে তিনি আগের রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাবেন কী করে? কিন্তু ডিমের কুসুমের মতো ভোরের লালচে সূর্য তাঁর মন ভালো করে দিল।এমন সময় তিনি কাঁধে কার যেন হাতের স্পর্শ পেলেন। ফিরে দেখেন মিলি দাঁড়িয়ে আছে। তার চেহারায় নতুন সকালের আলো এসে পড়েছে। হাতে চায়ের কাপ। আজমল সাহেবের মনে হলো, আরে, এ পরি মেয়েটি আমার এখানে কোত্থেকে এলো? তিনি মিলির মাথায় হাত রেখে বললেন, কী রে মা, এত ভোরে কী করিস? কাল ঘুমাসনি ঠিকভাবে? কতো ঝামেলা গেল, রেস্ট নেওয়া দরকার ছিল না? মিলি মৃদু হেসে বলল, ঘুমিয়েছি বাবা, কিন্তু ভেঙে গেল। তোমার চা দিতে হবে না?আজমল সাহেবের হঠাৎ মন খারাপ হয়ে গেল, আজ মেয়েটি চলে যাবে। কাল থেকে তাঁকে চা দেওয়ার কেউ থাকবে না।তিনি চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বললেন, “তোকে খুব ক্লান্ত লাগছে। যা, একটু ঘুমা। তোর বান্ধবীরা কই?” “আমি তোমাকে নাস্তা করিয়ে একটু শোব বাবা, আর আমার বন্ধুরা ঘুমাচ্ছে।” বলতে বলতে সে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, আমি টেবিলে নাস্তা দিচ্ছি, তুমি গিয়ে বসো তো বাবা। আজমল সাহেবের মন আবার খারাপ হয়ে গেল, তাঁকে কাল কে নাস্তা দেবে? বা রাতের খাবার? মশারি টানাবে কে? তিনি কিছুটা মন খারাপ করে বাড়ির ভেতরে যাচ্ছেন। মিলির রুম থেকে হালকা সুরে ভিনদেশি গান ভেসে আসছে। তাঁর একটু মন খারাপ হলো। মেয়ের বিয়েতে বিদেশি গান কেন? বিসমিল্লাহ খাঁ এর সানাই বাজলে ভালো হতো না? খাঁ সাহেবের মতো আর কেউ কি বিয়ের মেজাজ তুলে ধরতে পারেন? তিনি জানেন না, যে গানটি বাজছে তা হচ্ছে, ‘কারেন গিবসন’ এর ‘Stand by me’ গানটি। ২০১৮ সালে বৃটেনে প্রিন্স হ্যারি আর মেগান মার্কেলের বিয়েতে তিনি তাঁর দলসহ এ গানটি গেয়েছিলেন। যদি জানতেন হয়তো আজমল সাহেব খুশিই হতেন। তাঁর রাজকন্যার বিয়েতে তো রাজকীয় গানই বাজানো উচিত।নাস্তার টেবিলে তাঁর সাথে বসেছে মিলি। কিন্তু সে খাচ্ছে না। বাবাকে বেড়ে দিচ্ছে। তার হাতের মেহেদির ফুলগুলোকে মনে হচ্ছে জীবন্ত। এক্ষুনি বাতাসে দুলে উঠবে। গা থেকে ভেসে আসছে বাসি মেহেদির অপূর্ব সুবাস। তিনি খাবার নিতে নিতে বললেন, “মা, তুই খাবি না?””না, বাবা আমার বন্ধুরা উঠলে এক সাথে খাব।””ওদের যত্ন নিস মা। আমার খুব শখ ছিল তোর বিয়েটা অনেক বড়ো করে দেব। হলুদে হবে বিশাল উৎসব। কিন্তু কিছুই হলো না। আমি দরিদ্র মানুষ—-“তাঁর কথা মিলি থামিয়ে দিয়ে হাত ধরে বলল, “বাবা, যা হচ্ছে এই যথেষ্ট ।” তারপর অবাক হয়ে বলল, “বাবা, তুমি কাঁদছো?” আজমল সাহেব দ্রুত চোখ মুছে বললেন, “নারে মা, তোর মায়ের কথা মনে পড়ায় খারাপ লাগছে। সে থাকলে কতো খুশি হতো।”মিলি বিষণ্নভাবে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। কাল রাতে আসলে সে মায়ের কথা ভেবে ঘুমাতে পারেনি। আহ! আজ যদি মা বেঁচে থাকতেন! কী আদুরে মহিলা ছিলেন। সারাদিন টুকটুক করে পান খেতেন, ঠোঁট হয়ে থাকতো লাল। মিলি মাঝে মাঝে রাগ করে বলত, “মা, কী বাজে অভ্যেস! পান খেলে ক্যান্সার হয় জানো না?” তিনি মিষ্টি হেসে উত্তর দিতেন, “ওইসব ফালতু কথা মা। আমার মা-শাশুড়ি সারা জীবন পান খেয়েছেন, কই কিছু তো হয়নি।” মিলি কপট রাগ দেখিয়ে বলতো, “দাদুই তো তোমাকে পান খাওয়া শিখিয়েছেন। বউ এর লাল টকটুকে ঠোঁট না দেখলে নাকি বুড়ির মন ভরতো না।” মা আবার আদুরে হাসি হাসতেন।তার ভাবনা ছুটে গেলো মোবাইলের শব্দে। বাবার ফোন। তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, আজ আমার মেয়ের বিয়ে, ছুটিতে আছি, তারপরও অফিস থেকে শান্তিতে থাকতে দেবে না। ফোন ধরতেই তাঁর চেহারায় চিন্তার ভাঁজ পড়লো। মিলি একটু উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, “বাবা, কোনো সমস্যা?” তিনি কথা না বলে মাথা নাড়লেন, তারপর ফোনের অপর পারের লোকটিকে বললেন, আমি আসছি স্যার। ফোন রেখেই বললেন, “মা ,আমাকে একটু অফিসে যেতে হবে। জিএম সাহেব ডেকেছেন।”মিলি আবার জিজ্ঞেস করলো, “বাবা, কোনো সমস্যা?” তার গলায় গভীর উদ্বেগ। “না, মা, তেমন কিছু না, আমি কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসব। চিন্তা করিস না।”বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় তিনি যদি মিলির দিকে তাকাতেন তাহলে দেখতেন, তাঁর রাজকন্যা নিঃশব্দে কাঁদছে। কিন্তু তাঁর দেখার সময় নেই। যে দিনটি খুব ভালোভাবে শুরু হয়েছিল তা হঠাৎ অন্যদিকে মোড় নিয়েছে বলে তাঁর মন বলছে। নয়তো মেয়ের বিয়ের দিন ছুটিতে থাকার পরও তাঁকে অফিস থেকে ডাকা হতো না। সম্ভবত ঝামেলা হয়েছে। এমনিতেই কয়েকদিন থেকে একটি এলসি নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে। ওভার পেমেন্ট হয়ে গেছে, ওটা ফিরিয়ে আনতে অনেক সমস্যা হবে। তিনি যখন অফিসে পৌঁছালেন তখন দেখলেন সবার মুখ কেমন থমথমে। এমন কি রিসেপশনিস্ট মেয়েটি পর্যন্ত পাথরের মতো শক্ত হয়ে বসে আছে। অথচ তার কাজই হচ্ছে হাসিমুখে সবাইকে অভ্যর্থনা জানানো। কিন্তু সে-ই বসে আছে থমথমে আষাঢ়ের চেহারা নিয়ে।ভেতরে ঢুকতেই দেখেন একই অবস্থা।সবাই চুপচাপ, কোনো সম্ভাষণ নেই, সালাম নেই।আজমল সাহেব শুধু অবাকই হলেন না, তাঁর ভয় ভয় করতে লাগলো। কী হয়েছে? কোম্পানি কি বন্ধ হয়ে গেছে? না এলসির ওভার পেমেন্ট ফেরত পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক চাইনিজ কোম্পানি এধরনের কাজ করে। এদের ব্যাবসার নীতিবোধ খুব কম। তিনি ধীর পায়ে নিজের রুমে বসলেন। একটু পর ইন্টারকম বেজে উঠলো। এমডি সাহেবের পিএ। তিনি তাঁকে সালাম দিয়েছেন। এবার তাঁর হৃৎকম্প শুরু হলো। এমডি আরিফুল হাসানকে শুধু অফিসের লোক ভয় পায় তা না। সারা দেশের ব্যবসায়ীরাই ভয় পায়। কারণ কেউ তাঁর পথে বাধা হলে তিনি তা চরম নৈপুণ্য এবং নিষ্ঠুরতার সাথে গুঁড়িয়ে দেন। এজন্য আড়ালে তাঁকে ‘বুলডোজার’ ডাকা হয়। তাঁর সাথে পাল্লা দিতে এসেছে, কিন্তু চাট্টিবাটি গুটিয়ে ব্যবসা থেকে পালায়নি এমন কেউ নেই।চেম্বার ইলেকশনে একজন তাঁর বিরোধিতা করেছিলেন। আগের রাতে সে ভদ্রলোকের বাড়িতে একটি উপহার যায়। চমৎকার র্যাপিং করা গিফট বক্স। খুলে দেখা গেলো তাতে দুটো কেউটে সাপ! ফোঁস ফোঁস করছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সাপগুলো বাসায় মিলিয়ে গেল। ভদ্রলোক পরিবার-সহ সোজা হোটেলে গিয়ে উঠলেন। জনসম্মুখে চেহারা দেখালেন ইলেকশনের পনেরোদিন পর।এ ভদ্রলোকের সামনে পারতপক্ষে কেউ পড়তে চান না, তাঁর চোখের দৃষ্টিও অনেকটা সাপের মতো। ঠান্ডা, অনুভূতিহীন।তার উপর পিএ সাহেব বললেন, “স্যার যা বলবেন শুধু শুনে যাবেন। আজ বারুদ হয়ে আছেন। নাক বোঁচারা খুব ঝামেলা করছে। বলছে পরের শিপমেন্টে ওভার পেমেন্ট অ্যাডজাস্ট করতে। অথচ এদের সাথে আর ব্যাবসা করার ইচ্ছা স্যারের নেই।”কথাটা শুনে আজমল সাহেব ঘামতে লাগলেন। তিনি খুব ভয়ে ভয়ে রুমে ঢুকলেন। এমডি সাহেব তখন গভীর মনোযোগ দিয়ে মেইল পড়ছেন। তাঁর ভ্রু কুঁচকানো। কোনো কথা বলছেন না। যেন আজমল সাহেব রুমে আছেন তা খেয়ালই করেননি।অনেকক্ষণ পরে নিজের মনেই বললেন, ‘স্টুপিড।’আজমল সাহেব আরো ভড়কে গেলেন। গালিটা কি তাঁকে দেওয়া হলো না চাইনিজদের?এবার আরিফ সাহেবের শীতল চোখ আজমল সাহেবের সারা শরীরে কী যেন খুঁজল। তারপর তিনি বললেন, ‘বসুন।’আজমল সাহেব আবার ধাক্কা খেলেন। এমডি সাহেব এমন কি জিএম লেভেলের কর্মকর্তাদেরও তাঁর সামনে বসতে বলেন না।তিনি ইতস্তত করতে লাগলেন। আরিফ সাহেব একটি রূপার কাটার দিয়ে চুরুটের মাথা কাটতে কাটতে বললেন, “বসুন, অফিসিয়াল ব্যাপার হলে আপনাকে বসতে বলতাম না। ব্যাপারটা সাদাত সাহেব সংক্রান্ত। তিনি আমাকে আপনাকে একটি খবর দিতে বলেছেন। তা হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যে আপনাকে তাঁর সাথে দেখা করতে হবে।”এবার আজমল সাহেব আরো ভড়কে গেলেন। সাদাত সাহেব মিলির শ্বশুর হতে যাচ্ছেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে কোনো মিল নেই, একজন কাঞ্চনজঙ্ঘা শৃঙ্গ আর আরেকজন গ্রাম্য টিলা বলা যায়। এ আত্মীয়তাও অবিশ্বাস্য। সাদাত সাহেবকে বলা হয় ‘টাইকুন অব দ্য টাইকুনস’। দেশের সেরা ধনী। তাঁর ছেলে আজমল সাহেবের মতো অ্যাকাউন্টসের কেরানির মেয়েকে বিয়ে করবে, এটা কেবল স্বপ্নেই সম্ভব। কিন্তু স্বপ্নও মাঝে মাঝে বাস্তব হয়। এখানেও তাই হয়েছে। মিলি এমবিবিএস করার পর সাদাত সাহেবের হাসপাতালে জয়েন করেছিল, সেখানেই তাঁর একমাত্র ছেলে আবরারের তার ওপর চোখ পড়ে। এরপর সব ওলট-পালট হয়ে যায়। সে বাবাকে জানিয়ে দেয়, বিয়ে যদি করতেই হয় সে এ মেয়েকেই করবে। সাদাত সাহেব প্রথমে হতভম্ব, তারপর রাগে ফেটে পড়েন। মিলিকে এক কথায় চাকুরি থেকে বের করে দেওয়া হয়। যেদিন মিলি বিদায় নেয়, ঠিক সেদিনই আবরার ষোলোট ঘুমের ওষুধ খায়। এরপর সাদাত সাহেব আর আপত্তি করেননি। তবে আজমল সাহেবের সাথে কোনো যোগাযোগও করেননি। সব কথা বলেছে তাঁর লোকজন।আজমল সাহেবের কাছে ব্যাপারটা অপমানজনক হলেও তিনি কিছু বলেননি। গ্রাম্য টিলা কাঞ্চনজঙ্ঘাকে কিছু বলতে পারে না। সে ক্ষমতা তার থাকে না। সবচে বড়ো কথা, মিলির এ বিয়েতে আগ্রহ আছে এবং সেটা তার শ্বশুরের টাকাপয়সার জন্যও নয়। বাবার সাথে তার সম্পর্ক বন্ধুর মতো। সে বলেছে, “বাবা, আমি আবরারকে বিয়ে করছি। ও তো তোমাকে কোনো অসম্মান করেনি। বাবার সম্পত্তির প্রতি ওর কোনো আগ্রহ নেই। সে তো আমার মতোই ডাক্তার। আর বিয়ের পর ও বাড়ির নিয়ম অনুযায়ী আমরা আলাদা বাড়িতে থাকব। সাদাত সাহেবের সাথে তোমার দেখা হবে না। আবার এমনও হতে পারে, তুমি সাদাত সাহেবকে যতোটা অহংকারী ভাবছ, তিনি তা নাও হতে পারেন। তাছাড়া,আমি তো কয়েক মাসের মধ্যে জন হপকিন্সে পড়তে চলে যাব। স্কলারশিপ হয়ে গেছে। ফিরে আসার পর আবরারের বা তার বাবার টাকার উপর আমাকে নির্ভর করতে হবে না। আর বাবা, বিশ্বাস করো ছেলেটা ভালো। বাবার মতো নয়। তুমি চিন্তা করো না।” আজমল সাহেব কিছু বলেননি, মেয়ের হাত ধরে চুপচাপ বসেছিলেন।বাবারা অনেক কথাই বলতে পারেন না। নিস্তব্ধতাই তাঁদের ভাষা। কিন্তু তাঁর স্বস্তি হচ্ছে না। তিনি মৃদু গলায় বললেন, “গরিবের মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে সম্মান পায় না, মা। আমার ভয় সেখানেই। আমি সামান্য চাকুরে। আমাকে কি ওই বাড়িতে ঢুকতে দেবে?মিলির চোখ ছলছল করছে, “সে বলল, বাবা, ওই বাড়িতে তোমাকে ঢুকতে না দিলে আমিও কখনো সে বাড়ির কড়া নাড়ব না। তুমি যাবে তোমার মেয়ের বাড়িতে বাবা। যখন আমি আলাদা হব।” আজমল সাহেবের আর কথা বলে মেয়ের মন খারাপ করে দিতে ইচ্ছে করল না। মা মরা মেয়ে, তিনিই তার মা, তিনিই তার বাবা।কতো দ্রুত মেয়েটা বড়ো হয়ে গেলো! অথচ এই সেদিনও রাতে তাঁর গলা জড়িয়ে ঘুমাত।তাঁর ঘোর ভাঙলো আরিফ সাহেবের কথায়, “বলার পরও না বসাটা কিন্তু আমার পছন্দ হচ্ছে ন।”এবার আজমল সাহেব তড়িঘড়ি করে বসলেন।আরিফ সাহেবের চুরুটের আগুন জ্বলছে, নিভছে, পুরো রুমে মিষ্টি একটি গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে।বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিনি মনোযোগ দিয়ে চুরুট টানতে লাগলেন, তারপর বললেন, “সত্যি বলতে কী আপনার সাথে সাদাত সাহেব সম্পর্ক করছেন, এটা আমি কোনোভাবেই নিতে পারছি না। টাইকুন অব দা টাইকুনস ছেলের বউ করছেন একজন অ্যাকাউন্টসের কেরানির মেয়েকে! নো, এটা তাঁর সাথে যায় না। তাঁর মতো ভয়ংকর অহংকারী মানুষ আমি খুব কম দেখেছি, অ্যান্ড সো রুথলেস হি ইজ।”কথাগুলো আজমল সাহেবের বুকে এসে বিঁধলো। তিনি নিজের অজান্তেই বলে ফেললেন ,”স্যার,আমার মেয়ে কিন্তু এমবিবিএস পরীক্ষায় সারাদেশে দ্বিতীয় হয়েছে। আমেরিকার জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুল স্কলারশিপ পেয়েছে। তাছাড়া ওনার ছেলের আগ্রহেই বিয়েটা হচ্ছে।”আরিফ সাহেব চুরুটে দীর্ঘ একটি টান দিয়ে লাল আগুনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, ‘মার্টিনি অ্যাফেক্ট।'”বুঝলাম না স্যার।””স্কুবা ডাইভাররা যখন পানির নিচে ডুব দেয় তখন তাদের মধ্যে এ অ্যাফেক্ট দেখা দেয়।””সরি স্যার—-“আরিফ সাহেব চুরুটের ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন, “ডিপ ইন ওয়াটার, ভেরি ডিপ ইন ওয়াটার, ডাইভাররা যখন গভীর সমুদ্রে ডুব দেয়, তখন তারা অন্য এক ধরনের আনন্দে ঘোরের মধ্যে চলে যায়। ব্রেইন তাদের একটি ফলস নিরাপত্তা সিগন্যাল দেয়। এলএসডি খেলে যেমন মনে হয় পঞ্চাশ তলা থেকে লাফ দিলেও কিছু হবে না, এ ফলস অ্যালার্মের কারণে তাদের মনে হয় সাগরের অতল গভীরে তারা মাতৃগর্ভের মতোই নিরাপদ। এ বিভ্রান্তি থেকে তারা অক্সিজেন মাস্ক খুলে ফেলে এবং ভুলটা শুধরানোর সুযোগ পায় না। তার আগেই মারা যায়। মৃত্যুর আগে থাকে গভীর আফসোস—–” বলতে বলতে তিনি চুরুটের নীল ধোঁয়া উড়াতে লাগলেন। তারপর বললেন, “বিখ্যাত জুতো কোম্পানি ‘নাইকি’র মালিক ফিল নাইটের বড়ো ছেলে মার্টিনি অ্যাফেক্টেই সমুদ্রের তলায় মারা গিয়েছিলো।”আজমল সাহেব তীব্র অস্বস্তি নিয়ে বসে আছেন, তিনি বুঝতে পারছেন না এমডি সাহেব কী বলতে চাইছেন। আরিফ সাহেব এবার সরাসরি তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আই অ্যাম অ্যাফ্রেইড, সাদাত সাহেবের ছেলে আপনার মেয়ের ব্যাপারে এধরনের মার্টিনি অ্যাফেক্টে ভুগছে কি না। ‘ভুল’ ভালো লাগার ভুল, ভুল ভালোবাসার ভুল, আ কমপ্লিট ফলস ইয়োফোরিয়া। সে কি ঘোরের মধ্যে আছে? সমস্যা হচ্ছে স্কুবা ডাইভাররা ভুলটা সংশোধনের সুযোগ পান না, কিন্তু সাদাত সাহেবের ছেলে তা পাবে।”আজমল সাহেব থরথর করে কেঁপে উঠলেন।এমডি সাহেব মৃদু স্বরে বললেন, “আই ডু প্রে ফর ইয়োর ডটার। ঠিক আছে, আপনি যান, সাদাত সাহেবের সাথে দেখা করুন।”আরিফ সাহেবের নরম কণ্ঠ আজমল সাহেবকে অবাক করলো, কারণ এতো মৃদু কণ্ঠে তাঁকে কেউ কথা বলতে শুনেনি। কিন্তু তা তাঁকে স্বস্তির বদলে উগলে দিলো তীব্র ভীতি। আসলেই কি আবরার ঘোরের মধ্যে আছে? ভুল ঘোর? নাইকির মালিকের ছেলের মতো সমুদ্রের তলায় ভ্রান্তি বিলাস? এটা কেটে গেলে সে কি মিলিকে পরিত্যক্ত করবে? তাঁর বুক চিনচিন করতে লাগল। মনে হচ্ছে মাথা চক্কর দিচ্ছে। তারপরও তিনি কোনোরকমে জিজ্ঞেস করলেন, “স্যার, সাদাত সাহেব কি এখানে আসবেন, না আমি তাঁর অফিসে যাব?”আরিফ সাহেব হাসলেন, “আজমল সাহেব বাঘ কখনো ছাগলের আস্তানায় পা দেয় না। যদি দেয় তা ছাগলের জন্য ভালো হয় না, কারণ সে আগমন ঘটে ছাগল শিকারের জন্য। আপনিই যাবেন তাঁর কাছে। আমি সেক্রেটারিকে বলে রেখেছি আপনার জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করতে।” টলতে টলতে আজমল সাহেব বড়ো সাহেবের রুম থেকে বেরিয়ে এলেন।একমাত্র একজন বাবা যখন তাঁর অতি আদরের কন্যাকে অনিশ্চয়তায় সঁপে দেন তখনই এরকম পা কাঁপে। এটা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার পা কাঁপা নয়। এতে লেপ্টে থাকে তীব্র অসহায়ত্ব, যা পায়ের পেশিকে অচল করে দেয়।বাইরে বেরিয়ে গাড়িতে উঠে আজমল সাহেবের অস্বস্তি আরো বাড়লো। তিনি রিকশায় চড়া মানুষ, গাড়ির আরাম তাঁর ভালো লাগছে না। তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলেন সেখানে খণ্ড খণ্ড মেঘ। আবার তাঁর মনে কু ডাকল। মার্চের ঝকঝকে গরমে মেঘ কেন? তাঁর মনে হলো, তিনি তীব্র কালো মেঘের এক অভিজ্ঞতা অর্জন করতে সাদাত সাহেবের অফিসে যাচ্ছেন। যে মেঘ শুধু বুকে জমে, বাইরে থেকে দেখা যায় না। সাদাত সাহেবের অফিসে পৌঁছে আজমল সাহেব থমকে গেলেন। এটা কি অফিস না রাজপ্রাসাদ? বিশ তলা একটি দালান, বেশির ভাগ কাচের তৈরি, সে কাচে মেঘ ফাঁকি দিয়ে মাঝে মাঝে রোদ ঝিলিক মারছে। বাইরে থেকেই দেখা যাচ্ছে অসংখ্য মানুষ ভেতরে কাজ করছেন। আবার মাঝে মাঝে সোফা বিছানো। কোথাও আবার রকিং চেয়ার। সম্ভবত সাত তলায় ক্যাফে, সেখানে রঙিন সোফায় বসে অলস ভঙ্গিতে কেউ কেউ কফি খাচ্ছেন। যেন অফিস নয়, কোনো ফাইভ স্টার হোটেল! ভেতরে না ঢুকেই অফিস দেখে হতভম্ব হয়ে যেতে হয়। ভেতরে যেতে শত নক্তা। সিকিউরিটি বারবার জিজ্ঞেস করছে, কার কাছে যাবেন?উত্তর শুনে সে ভিরমি খেল। এ আধ ময়লা শার্ট, স্যান্ডেল পরা লোক যাবে এমডি স্যারের কাছে?সে বারবার কার কাছে যেন ফোন করে নিশ্চিত হলো, তারপর বললো, “লিফটে এগারো তলায় যান। ওখানে একজন রিসেপশনিস্ট আছেন। ওনাকে বুঝিয়ে বলবেন।”আজমল সাহেব লিফটে পা দেওয়ার মুহূর্তে দুর্বল রোদকে পরাজিত করে ঝুমঝুম বৃষ্টি নামল। এগারো তলায় চমৎকার একটি নৃত্যরত মূর্তি স্বাগত জানাচ্ছে। সে আবার ভাসছে একটি ছোট্ট সুইমিং টাইপ জলাধারের উপর। তার উপর নেমে আসছে ঝর্ণার জল। মনে হচ্ছে একটি মেয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে জলের উপর নাচছে। বাইরের বৃষ্টির সাথে ব্যাপারটা এত মিলে গেছে, মনে হচ্ছে ভেতর আর বাইরের আবহ কোনো শিল্পী নিজের হাতে তৈরি করেছেন। রিসেপশনিস্ট এর কাছে আবারো জবাবদিহি। অতি ঠান্ডা মাথার মানুষ হয়েও আজমল সাহেব রেগে উঠছেন। হোক না এরা বিলিওনিয়ার, কিন্তু তিনি তো সাদাত সাহেবের বেয়াই হতে যাচ্ছেন। তাঁর কি তিনি আসবেন এটা রিসেপশনে বলে রাখা উচিত ছিলো না? তাঁকে পাত্তা না দিয়ে অপেক্ষা করতে বলা হলো, কারণ স্যার নাকি জরুরি মিটিঙে আছেন। রাগ দমন করে তিনি ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করতে লাগলেন।প্রতীক্ষাও শেষ হয় না। এদিকে আবার খুব খিদে লেগেছে। সেই যে ঢোকার পর একজন উর্দি পরা ওয়েটার চা আর বিস্কিট দিয়ে গেছে তারপর আর কারো দেখা নেই।তিনি মাঝখানে একবার উঠে গিয়ে রিসেপশনিস্টকে জিজ্ঞেস করে কোনো উত্তর পাননি। রাগে তাঁর শরীর কাঁপছে। তিনি কি এতোই ফ্যালনা যে, তাঁকে ভিখারির মতো আচরণ করা হবে? তাঁর বদ্ধমূল ধারণা এ বিয়েতে তাঁর মেয়ে সুখী হবে না। এমন কি হয়তো তাঁকে মেয়েকে দেখারও অনুমতি দেওয়া হবে না, তাঁকেও বাবার বাড়ি যেতে দেওয়া হবে না। সে হবে সোনার খাঁচায় বন্দি রাজকন্যা। আ প্রিন্সেস ইন গোল্ডেন কেইজ। তাঁর ইচ্ছে হচ্ছে বিয়েটা ভেঙে দিতে। কিন্তু তা পারা যাবে না। তিনি দরিদ্র একজন বাবা, তাঁর পক্ষে এদের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে ভাঙা সম্ভব না। সবচে বড়ো কথা, মিলির এ বিয়েতে মত আছে। তাঁর মনে হলো, মেয়েটা বড়ো ধরনের ভুল করেছে। ভয়ংকর ভুল। সাপকে রশি ভাবার মতো ভুল। এদিকে বাড়ি ফিরে যাওয়া খুব দরকার। কতো কাজ! বিয়ের আয়োজনের ব্যাপারটা যদিও তাঁর ভাই দেখছেন, কিন্তু নিজে উপস্থিত না থাকলে স্বস্তি পাওয়া যায় না।এতো চিন্তার মধ্যেও তিনি অপেক্ষা করতে করতে এক সময় ঝিমুতে লাগলেন।ঘণ্টা দুয়েক পর ডাক এলো। স্যুট পরা এক তরুণ এসে অনেকটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললো, “আসুন, স্যার ফ্রি হয়েছেন।”ভেতরে ঢুকে তিনি থমকে গেলেন। অফিস রুমের চাকচিক্যে নয়, সেটাতে আগেই চোখ ধাঁধিয়ে গেছে। তিনি অবাক হলেন চেয়ারে বসা মানুষটিকে দেখে।তাঁর চোখে আগুন। লাল আগুন নয়। নীলচে আগুন রং চোখের তারায়। সেখানে ক্রুরতা, নিষ্ঠুরতা আর তীব্র মমতাহীনতা খেলা করছে। আজমল সাহেবের মনে হলো তিনি কোনো প্রচণ্ড উম্মত্ত এক শক্তির সামনে এসে পড়েছেন। যে শক্তিটা ভালো কিছু নয়। তাঁর এক্ষুনি পালানো উচিত। আবার সব অনুভূতির ঊর্ধ্বে উঠে তাঁর মনে হলো, এ লোকের বাড়িতে তাঁর মেয়ে টিকবে কীভাবে? যে মেয়েকে এখনো মাঝে মাঝে তাঁর নিজ হাতে ভাত খাইয়ে দিতে হয়?তাঁর আবার মনে হলো, আহা! তাঁর রাজকন্যা সাপকে রজ্জু ভেবেছে। রুমের নীরবতা ভাঙলো সাদাত সাহেবের কণ্ঠে, তিনি তাঁর সেক্রেটারিকে বললেন, “আউট। বাইরে লাল বাতি জ্বালিয়ে দাও। নো টেলিফোন, নো নক অন দা ডোর। আউট।”তাঁর কণ্ঠে তীব্র কাঠিন্য। তিনি সে তীব্র কাঠিন্য নিয়েই আজমল সাহেবকে বললেন, ‘বসুন।’ একবারও এত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করিয়ে রাখার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন না।তারপর বললেন, “আপনার সাথে আমি দশ মিনিট কথা বলবো। এরপর হয়তো আমাদের আর কোনো দিন কথা হবে না। আমার সে সময় নেই। টাইম ইজ ডায়মন্ড ফর মি। ভেরি প্রেশাস ডায়মন্ড।”আজমল সাহেব অপমানে থরথর করে কেঁপে উঠলেন। তাঁর তীব্র পিপাসা পেয়েছে। তার সাথে যোগ হয়েছে ভয়। মাথায় সব শূন্য মনে হচ্ছে।সাদাত সাহেব বললেন, “আমি আপনার ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছি। আপনি আরিফের ওখানে অ্যাকাউন্টস এর কেরানি। সেটা ছাড়াও আমার আরো কিছু জানার দরকার আছে। আশা করি, সত্যি কথা বলবেন। তবে না বললেও অসুবিধা নেই। আমার সোর্স সব ঠিকই বের করে আনবে।”আজমল সাহেব ঘামছেন। অপমান নয়, এখন তাঁর ভয় ভয় লাগছে। এ লোক কী বলবে? বিয়ে ভেঙে দেবে? দিলে সমস্যা নেই, শুধু চিন্তা মিলি ব্যাপারটি কীভাবে নেবে? বাংলাদেশে বিয়ে ভাঙা মানে চিরদিনের জন্য দাগ পড়ে যাওয়া। তাঁর এত আদরের মেয়ে! তিনি কিছু না বলে চুপচাপ বসে রইলেন।আজমল সাহেব একটি পেপার কাটার নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। কোনো কথা বলছেন না। পুরো ঘরে এক ধরনের নীরবতা। শুধু হালকা সুগন্ধ ভেসে আসছে। যেন একযুগ পর সাদাত সাহেব মুখ খুললেন, “নব্বই দশকে আপনি কুলাউড়া গাজিপুর চা বাগানে ছিলেন তাই না? ইস্পাহানির বাগান। আপনি ছিলেন ক্যাশ বাবু, ঠিক বলেছি?” আজমল সাহেবের পেটে মোচড় দিলো। উনি কোনদিকে যাচ্ছেন? চা বাগানে তিনি কাজ করেছেন, এটা সত্য, কিন্তু কোনো অন্যায় তো করেননি। এটা গোপন করার কোনো বিষয় নয়, এ ব্যাপারটা কেন আলোচনায় আসবে? চা বাগানে কাজ করা কি অপরাধ? সাদাত সাহেব বলে যাচ্ছেন, তাঁর গলায় কোনো ওঠানামা নেই, যেন কোনো রোবট কথা বলছে। প্রতিটি শব্দ আগেই মাথায় রেকর্ড করা আছে।”বাগানটি ভারতের সাথে লাগানো। ওপারেই ভারতীয় গ্রাম। নাম রাঘনা। সাধারণ, দরিদ্র, প্রত্যন্ত একটি গ্রাম। কিন্তু গ্রামটি কুখ্যাতি অর্জন করেছিল, কারণ সেটা ছিল ভারতের একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী গেরিলাদের ঘাঁটি। তারা মাঝে মাঝে ভারতীয় বাহিনী, বিশেষ করে ‘বিএসএফ’ এর উপর চোরাগুপ্তা হামলা করে বাংলাদেশে ঢুকে পড়তো। ১৯৯৭ সালের মার্চ মাসে এরা ‘বিএসএফ’ এর একটি কনভয়ে অ্যাটাক করে। এতে প্রচুর হতাহত হয়। এরপরই ভারতীয় সরকার তাদের বিরুদ্ধে কম্বিং অপারেশন শুরু করেন। গেরিলাদের বেশির ভাগই এ অপারেশনে নিহত হয়। অনেকেই পালিয়ে যায়। এর মধ্যে একটি দল সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। ধারণা করা হয় এদের মধ্যে তাদের শীর্ষ নেতাও ছিলেন। যাই হোক, তারা আশ্রয় নেয় আপনাদের বাগানের কুলি পল্লিতে। ইচ্ছে করে তাদের আশ্রয় দেওয়া হয়নি। বন্দুকের মুখে তারা বাধ্য করে আশ্রয় দিতে। “অনেকক্ষণ কথা বলে সাদাত সাহেব থামলেন। সামনে রাখা গ্লাস থেকে পানি খেলেন। সেটা দেখে আজমল সাহেবের তৃষ্ণা আরো বেড়ে গেলো। কিন্তু পানি চাওয়ার সাহস তাঁর হচ্ছে না। বাগানে গেরিলাদের এ ঘটনা তিনি জানেন। কিন্তু এর সাথে তাঁর সম্পর্ক কী? সাদাত সাহেবের যান্ত্রিক কণ্ঠ আবার প্রাণ পেয়েছে। তিনি বলতে লাগলেন, “সাতানব্বই এর সাতই এপ্রিল রাতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বাগানের কুলি পল্লিতে ঢুকে পড়ে। নিজস্ব ইন্টেলিজেন্সে তারা জানতে পারেন সেখানে গেরিলারা আশ্রয় নিয়েছে, সম্ভবত ভারত সরকারও তা জানিয়েছিলেন। সেদিন রাতেআর্মি সর্বশক্তি দিয়ে অভিযানে নামে। শুরু হয় প্রচণ্ড বন্দুক যুদ্ধ। বিচ্ছিন্নতাবাদী গেরিলাদের অনেকেই এতে মারা পড়ে, তবে বেশ কয়েকজন পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়। কিন্তু যাওয়ার আগে তারা একটি কাজ করে। ভয়ংকর একটি কাজ। তারা গান পাউডার দিয়ে পুরো কুলি পল্লি জ্বালিয়ে দেয়। তাদের ধারণা ছিলো কুলিদের কেউ আর্মিকে তাদের খবর পৌঁছে দিয়েছিল। তাই এ প্রতিশোধ। মুহূর্তের মধ্যে দাউদাউ করে শ্রমিকদের বাড়ি জ্বলতে থাকে। একদিকে আগুন, অন্যদিকে পাল্টা গোলাগুলি, এ অবস্থায় কেউ তাদের রক্ষা করতে যেতে পারেনি। শুধু আর্মির লোকজন কিছু করার চেষ্টা করেন, কিন্তু তাতেও তেমন কাজ হয়নি। কারণ তাঁরা নিজেরাই প্রাণের ঝুঁকিতে ছিলেন, তার উপর আশেপাশে পানির ব্যবস্থাও ছিলো না। আবার গান পাউডারের আগুন সাধারণ আগুন নয়, মুহূর্তে সব জ্বালিয়ে ছারখার করে দেয়। ঘণ্টা তিনেক পর গেরিলারা পালিয়ে যাওয়ার পর সেনাবাহিনী এবং বাগানের লোকজন গিয়ে দেখে পুরো কুলি পাড়া ছাই হয়ে গেছে। অনেকেই মারা গেছে, কেউ কেউ মারাত্মক আহত। সেই দর্শকদের মধ্যে আপনিও ছিলেন। তাই না?””জি, স্যার।” এই প্রথম আজমল সাহেব রুমে ঢুকার পর কথা বললেন।”আই সি”, বলে সাদাত সাহেব আবার পানি খেলেন। “হতাহতের অবস্থা পরীক্ষা করার পর দেখা গেলো একটি শ্রমিক পরিবারের সবাই মারা গেছে, একজন বাদে।”এবার আজমল সাহেবের বুকে ধাক্কা লাগলো। সেখানে চিনচিন ব্যথা, তা পেশিতে ছড়িয়ে পড়ছে। । তিনি বুঝতে পারছেন ঘটনা কোন দিকে যাচ্ছে। সাদাত সাহেব কী বলতে চাইছেন। গত তেইশ বছর যে কথাটি তিনি কখনোই শুনতে চাননি, মনে করতে চাননি, তাই এখন তাঁকে শুনতে হবে। কিন্তু কেন? সাদাত সাহেবও চুপ করে আছেন। তারপর উঠে গিয়ে বিশাল জানালার সামনে দাঁড়ালেন। বাইরে অসময়ের বৃষ্টি। তিনি সেদিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে আচমকা পেছন ফিরে আজমল সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনি মিথ্যে বলেছেন কেন? হোয়াই ইউ লায়েড? তাঁর চোখ রক্তবর্ণ, সেখানে উম্মাদ ভাব আবার ফিরে এসেছে।আজমল সাহেব কাঁপা কণ্ঠে বললেন, স্যার, আমি ওকে ভালোবাসি। প্রাণের চাইতে বেশি ভালোবাসি।”আজমল সাহেব ধপ করে নিজের চেয়ারে এসে বসলেন, “আপনি ওকে ভালোবাসেন? রিয়েলি?””স্যার বিশ্বাস করুন আমি — আমি—-“একটা মরা কুলির বাচ্চাকে আপনি ভালোবাসেন তা আমার জানার দরকার নেই। আমি মহামানব নই। আমার প্রশ্ন হচ্ছে আপনি এটা বলেননি কেন? কী কারণে আপনি আমার ছেলে বা আমাদের কাউকে বলেননি আপনার মৃতা স্ত্রী কোনো সন্তানের জন্ম দেননি। মিলি তাঁর গর্ভের বাচ্চা নয়, সে হচ্ছে চা বাগানের কুলির বাচ্চা, যারা সপরিবারে সে রাতে আগুনে কয়লা হয়ে গিয়েছিলো, শুধু বেঁচে ছিলো মিলি। আপনি তাকে আশ্রয় দেন। সে আপনার আশ্রিতা মাত্র। সে আপনার মেয়ে নয়, কুড়িয়ে পাওয়া কুলির মেয়ে। কেন বলেননি, কেন? ইউ চিটেড মি— ইউ চিটেড মাই সন।” তিনি রাগে কাঁপছেন। আজমল সাহেব দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠলেন, “স্যার, আমার মেয়েটিকে আমি খুব ভালোবাসি। প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি। সে এখনো আমার হাতে ছাড়া ভাত খায় না।””কিন্তু আগে বলেননি কেনো?” ‘স্যার, আমার মেয়ে, আমার মেয়ে, ওর কোনো দোষ নেই। আমি ওকে ভালোবসি স্যার——– আমি কীভাবে? কীভাবে? কথা শেষ না করে আজমল সাহেব আবার হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন।সাদাত সাহেব আবার চেয়ারে থেকে উঠে দাঁড়ালেন। টেবিলে রাখা পেপার কাটার নিয়ে তাতে আঙুল বুলাতে লাগলেন। তাঁর চেহারায় গভীর মেঘ,কপালে ঘাম।অনেকক্ষণ পর তিনি আজমল সাহেবের দিকে তাকালেন। তারপর অসম্ভব শীতল গলায় বললেন, “অপমান আর অমর্যাদার একটা সীমা আছে। ইনসাল্টেশন মাস্ট হ্যাভ আ লিমিট।” আজমল সাহেব মাথা নিচু করে বসে আছেন। তাঁর কিছু বলার নেই। সামনে বসা বাঘের মতো মানুষটি গলা আরো নামিয়ে বললেন, ” গুরু নানকের নাম শুনেছেন?” “জি না, স্যার।” “ভদ্রলোক শিখ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা। পাকিস্তানের লাহোরে তাঁর জন্ম। তার একটি কথা আছে, ‘দুগুনা দত্তার চোঁ গুনা জুজার,’ মানে হলো তুমি কাউকে দুইগুণ দিলে তা চারগুণ হয়ে ফিরে আসে। মানে আপনি যা করবেন তা দুইগুণ হয়ে ফিরে পাবেন। খোদা একদিন মিলির এক বাবাকে আগুনে কয়লা বানিয়েছিলেন, তাই আজ তিনি তাকে দুজন বাবা ফেরত দিচ্ছেন। এতদিন ছিলেন আপনি একা, আজ থেকে যোগ হলাম আমি। এক বাবার বদলে দুই বাবা। খোদার এ অসীম করুণা আপনি বুঝলেন না! আপনি ব্যাপারটা গোপন রাখলেন! এটা কি কোনো অপরাধ? ইজ ইট আ ক্রাইম? যে গোপন করতে হবে? রাদার ইটস আ ব্লেসিং অব দা গড, তিনি আপনাকে একটি বাচ্চা উপহার দিয়েছেন। কিন্তু আপনি এ অতি চমৎকার সত্যটি গোপন করেছেন। ইউ চিটেড দা অল মাইটি, আই ফিল পিটি, জাস্ট পিটি অন ইউ। আপনি তো মেয়েটির আসল পরিচয় না দিয়ে তাকে অপমান করলেন। আপনার কী ভাগ্য খোদা আপনাকে কী চমৎকার একটি মেয়ে উপহার দিলেন। আর আপনি সত্যটা অস্বীকার করলেন! বলতে বলতে তিনি আবার চেয়ারে বসলেন।”পরম করুণাময়ের অসীম মমতা বোঝার ক্ষমতা যার নেই, তার জন্য আমার করুণা ছাড়া আর কিছু হয় না।” এরপর ধীর পায়ে আবার চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে আজমল সাহেবের পাশে দাঁড়ালেন, তাঁর কাঁধে হাত রেখে বললেন “আমার দিকে তাকান। চোখ তুলুন।”জলের সমুদ্রে ভেসে যাওয়া চোখ তুলে আজমল সাহেব দেখলেন, দুনিয়ার সব মমতা নিয়ে সাদাত সাহেব তাঁর দিকে তাকিয়ে আছেন।তারপর তিনি তাঁর কাঁধে হাত রেখে বললেন,”আমাদের মেয়ে মিলির জন্য গুরু নানক কত বড়ো সত্য হয়ে দেখা দিলেন তাই না, আজমল সাহেব? দুগুনা দত্তার চোঁ গুনা জুজার——–“আজমল সাহেব বিকট শব্দ করে কেঁদে উঠলেন, কিন্তু অসময়ের তীব্র বাজ সশব্দে জানালার শার্সিতে ধাক্কা খাওয়ায় সে শব্দ হারিয়ে গেলো।#আসুনমায়াছড়াই। (মতামত আমাকে ঋণী করবে। গল্পটি শেয়ার বা ক্রেডিট দিয়ে কপি করা যাবে।)