তরুণ বন্ধু আমার- কেন আপনি বই পড়বেন?
১৯৭৩ সাল।
বড় আপার সদ্য বিয়ে হয়েছে। উৎসবের আমেজ তখনো মিলিয়ে যায়নি। এর মধ্যে মহা উত্তেজনা তৈরি করলো একটি গুজব। আপা নাকি মঞ্জু ভাইকে নিয়ে নিউ মার্কেট যাবেন। (দুলাভাইকে আমরা নাম ধরে ডাকতাম)
এটা একটা বিরাট খবর। কারণ নিউ মার্কেট মানে আমাদের জন্য প্যারিস কিংবা সুইজারল্যান্ড। সেখানে সব দামি দামি জিনিষ বিক্রি হয়। লিবার্টি নামের একটা দোকানে আইসক্রিম পাওয়া যায়, ওই জিনিষ যে একবার খেয়েছে সে নাকি বাকি জীবনে আবার তা আরেকবার খাওয়ার জন্য জান কবুল করে ফেলে। সেখানে একটা রেস্টুরেন্টে যে কাবাব বানানো হয়, তা খেয়ে নাকি ঢাকার নবাব ফ্যামিলির বাবুর্চি লজ্জায় লখনৌ পালিয়ে গেছেন। পত্র মারফত জানিয়েছেন, যে দেশে এমন ‘কাবাব-বাদশা’ আছেন সে দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে অবস্থান করে ইজ্জত বাঁচানো অতি জরুরি। আবার সেখানে যে জিনিষ পাওয়া যায়, তার কাছে নাকি দিল্লী মিল্লি তো অনেক পরের ব্যাপার, বিলাতও ফেইল। রানি এলিজাবেথের বরকান্দজরা নাকি এ নিয়ে বিশেষ লজ্জিত।
এরকম একটা জায়গায় বড় আপা যাবেন, আবার শোনা যাচ্ছে সেখান থেকে আমাদের জন্য উপহার কেনা হবে, এ রকম মারাত্নক খবর তো বিবিসি ও দেয় না!
সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আপা ঝলমলে হাস্যমুখে ‘বেবি ট্যাক্সি’তে চড়ে নিউমার্কেট রওনা হলেন। আর এদিকে বাড়িতে আমাদের তীব্র উত্তেজনা। আপা কখন ফিরবেন, কী আনবেন চিন্তা। গভীরভাবে চিন্তা করার জন্য সেদিন স্কুল বাদ গেলো। এটা বিরাট মাথা ঘামানোর ব্যাপার, স্কুলে অংক করে তা নষ্ট করা যাবেনা।
বিকেলে আনন্দ কল্লোলে আপা ফিরে এলেন। একদিকে নববধুর লালচে লজ্জা,আরেক দিকে ব্যাগ ভর্তি শপিং সব মিলিয়ে তাঁকে একেবারে অচেনা মনে হচ্ছে।
তিনি সে লালচে ভাব নিয়ে একের পর একটি উপহার বের করতে লাগলেন। আমি গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি, আমার জন্য কী বের হয় দেখার জন্য।
যে জিনিষ বের হলো তা দেখে মাথায় বাজ! সবার জন্য কত রঙ বেরঙের জিনিষ, আর আমার জন্য বের হলো একটি ইয়া মোটা বই!!!
বই!!!
আমার জানের দুশমন বই!
আমাকে সাতটা হাতি দিয়েও টেনে পড়ার টেবিলে নিতে পারে না, আর আমার জন্য আনা হয়েছে বই!!
আরো মেজাজ খারাপ হলো যখন দেখলাম পুষ্প আপার জন্য আনা হয়েছে একটি ছোট লাঠির মত কী যেন, তার মাথায় ছোট বুরুশ লাগানো, একই সাথে একটি মলমের সাদা-লাল রঙের টিউব। আমি বুঝতে পারছি না এটা কী দ্রব্য? পুষ্প আপা আবার জ্ঞানী মানুষ, ক্লাশে ফার্স্ট হয়, আবার দু’হাত খুলে ছেলেদের মারধোর করে বলে সবাই ভয়ও পায়। সে অতি জ্ঞানী কন্ঠে চিৎকার করে বলে উঠলো, টুথ ব্রাশ! টুথ পেস্ট! কী সুন্দর আপা!আমার কতদিনের শখ, টুথ ব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজবো, সাথে পেস্ট। তারপর আমার দিকে কোণা চোখে তাকিয়ে বললো, ‘কালো মাজন’ দিয়ে দাঁত মাজে ফকিন্নিরা।
একে আমার জন্য আনা হয়েছে বই, আর পুষ্প আপার জন্য আনা হয়েছে টুথ ব্রাশ আর পেস্ট, যেটা সে আমলে মহার্ঘ্য বস্তু তার উপর আমার দিকে তাকানো হচ্ছে কোণা চোখে, যেন উনি এর আগে এ জিনিষ কোনো দিন দেখেছেন। কালো মাজন দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে জান কয়লা, আবার বলে ফকিন্নিরা ছাড়া কেউ কালো মাজন দিয়ে দাঁত মাজে না—-
আমি কঠিন কন্ঠে বললাম, আমি বই এর খেতাপুরি। দিলে ঐ টুথ ব্রাশ আর পেস্ট নইলে খেতা—-
নতুন জামাই এর সামনে আমার অতি ‘বিনীত’ ভাষায় সবাই চমকে উঠলো, লজ্জায় তাড়াতাড়ি মেজ আপা লাফ দিয়ে উঠে আমার মুখ চেপে ধরলেন। হাসু আপা আবার খুব সহজ সরল, ও মিহি গলায় বললো, কোন সমস্যা নাই ভাইয়া, তোরা দুইজন ওই ব্রাশে দাঁত মাজিস। ভাগাভাগি করে —-
এবার বড় আপা নববধুর লজ্জা ভেঙ্গে হাসু আপার মুখ চেপে ধরলেন।
শেষমেষ আমাকে কিছু কাঠি লজেন্স দিয়ে পোষ মানানো হলো। কিন্তু বইটা পড়ার ধারে কাছেও আমি যাই না। পড়তে বললেই বলি, খেতাপুড়ি—-
আর আমার মুখ চেপে ধরা হয়।
এভাবে দিন যায়।
একদিন বইটা হাতে নেই। নাম দেখি ‘সাত নরির হার।’ পড়ার জন্য নেই নাই, নিয়েছি ওটা দিয়ে কটকটি কিনবো বলে। নতুন বই, ভালই কটকটি পাওয়া যাবে।
কী মনে করে মলাট উলটে দেখি। চোখ আটকে যায়। প্রথম পাতাতেই কী সুন্দর একটা মেয়ের ছবি! গল্পের নাম ‘সূঁই কুমারী।‘ সুন্দরী মেয়ের কী হলো জানার জন্য একটু পড়ে দেখতে মন চায়
খারাপ লাগে না। আফটার অল সুন্দরী মেয়ের গল্প!
এরপরের গল্প ‘ডালিম কুমার’। মেয়ের ছবি দেখি এইখানেও আছে। এটা ছেড়ে উঠি কীভাবে??ডালিম কুমারের প্রতি খুব হিংসা হয়।
ব্যাটার মধ্যে ‘মরদের’ কোন কোন লক্ষণ নেই, ঠিক মতো গুলতি মেরে কাক পর্যন্ত ফেলতে পারে না আর তাঁর ভাগ্যে জুটে ছবির মেয়েটি!
আমি কী দোষ করলাম???
রাজ্যের কাক -চড়ুই গুলতি দিয়ে খতম করে দেই, চরম সাহসের সাথে পাড়ার কুকুরদের লেজে ডানোর খালি টিন বেঁধে দেই, তারা ঠন ঠন টিন বাজিয়ে কলোনি কাঁপিয়ে ছুটে বেড়ায়। অথচ রাজকুমারী জুটে ফুলের গন্ধে ঘুমিয়ে পড়া ‘অলম্বুস’ ডালিম কুমারের ভাগ্যে!
কী আর করা। ভরা রাগ নিয়ে আবার পাতা উল্টাই।
এরপর বিরাট এক জলদস্যুর গল্প। গাধা টাইপ জলদস্যু। বয়ামে হাত ঢুকিয়ে আচার খেতে গিয়ে পটল তুলে!!
সেটা শেষ না হতেই, কোত্থেকে পরের গল্পে ‘ফুল কুমারী’ উঠে আসে। বনে তাঁর বাস। সেখানে শিকারে গিয়ে রাজপুত্র তার দেখা পায়।
আমার কেমন যেন ফুল কুমারীর কথা মনে হলেই লজ্জা লজ্জা লাগে।
রহিম বাদশার অবস্থা যাকে বলে!
ক্লাশ ওয়ানে পড়া রহিম বাদশা।
এভাবেই ‘সাত নরির হার’ নিয়ে বসে গেলাম।
সেই যে কটকটির কথা ভুলে গিয়ে বসলাম, আজ সাত চল্লিশ বছর ধরে বসে আছি!
ওঠা আর হলো না।
জানালার বাইরে কটকটিওয়ালার জন্য অপেক্ষার পালা পেরিয়ে চুলে মাঝে মাঝে ‘রূপা’ ঝিলিক দেয়।
কিন্তু উঠার সময় পেলাম না।
তবে এ দীর্ঘ বৈঠক শেষে আজ যেটা মনে হয়, বই পড়া আপনাকে যা দেবে তাহলো —
১। দুর্দান্ত আত্মবিশ্বাস।
২। জীবনে পাওনার চেয়ে বেশি পাওয়ার ক্ষমতা।
৩। বই আপনাকে যে স্মার্টনেস উপহার দেবে দুনিয়ার সেরা ডিজাইনারের পোশাকও তা আপনাকে দেবে না।
৪। অন্যের সমীহ অর্জন।
৫। শুধুই ‘সব কিছু’ অর্জনের ইঁদুর দৌড় থেকে রেহাই।
৬। সব সময় এক ধাপ না শত ধাপ এগিয়ে থাকার ক্ষমতা।
৭। হিংসা,বিদ্বেষ এসবের অনেক উপরে উঠার নির্মোহ ভাব।
৮। আপার হ্যান্ড। জ্ঞানের চে বড় অস্ত্র আর কিছু নেই।
৯। যে কাজই করুন, তাতে সেরাটা করতে পারা।
১০। অসাধারণ এক দৃষ্টি। যাতে যোজন মাইল দূর দেখার ক্ষমতা থাকে।
সব শেষে বলি, বই আপনাকে এক ধরনের ঘোরের মধ্যে রাখবে। যে ঘোরের মধ্যে মনে হবে, আপনার এক মাত্র কাজ হচ্ছে মানুষকে ভালবাসা।
বই হচ্ছে মায়ার জগত, তা আপনাকে কেবল মায়া দিয়ে মুড়ে রাখবে।
বই আপনাকে খারাপ হতে দেবে না। কখনোই না।
আর বই পড়ার খারাপ দিক কী জানেন?
এক ধরণের হাহাকার।
আমেরিকান সংগীতজ্ঞ ‘ফ্রাংক জাপ্পা’র মত সব সময় মনে হবে—
“সো ম্যানি বুকস
সো লিটল টাইম।”
তবে আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি, এর চে মধুর হাহাকার এখনো জগতে তৈরি হয়নি, কখনো হবেও না।
আসুনমায়াছড়াই।
( ১.লেখাটি ক্রেডিটসহ শেয়ার বা কপি করা যাবে।
২. বেশ পুরানো লেখাটি প্রাসঙ্গিক মনে হওয়ায় আবার পোস্ট করলাম।
৩.ছবির বুক এন্ড, যাতে লেখা ‘So many books, So little time’ জোগাড় করে দেওয়ার জন্য লন্ডন শপিংয়ের বন্ধুদের ধন্যবাদ)