বুক রিভিউ: বেড়াই ঘুরে দেশান্তরে।লেখক: মো. হুমায়ূন কবির ভূঁইয়া।ভ্রমন কাহিনী আমাকে খুব টানে। একদম ছোটো বেলা থেকে আমি লেখকদের সাথে সারা দুনিয়া কল্পনায় ঘুরেছি। মাথার পাশে যে বই দুটো আমার পাশে থাকে সেগুলো হচ্ছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ পায়ের তলায় সর্ষে’ আর Trevor Lund এর North To Alaska: The True Story of An epic, 16,000-mile cycle journey the length of the Americas.ইদানিং আমাকে মো. হুমায়ুন কবির ভূঁইয়ার ভ্রমন কাহিনী বেশ টানে। আরো একজনও বেশ টানেন, তিনি হলেন অঞ্জনা দত্ত।মজার ব্যাপার হলো এর দুজনের কেউ কিন্তু পুরোদমে লেখক নন। একজন সরকারী চাকুরি থেকে অবসর নিয়েছেন প্রায় পনের বছর আগে, আরেকজন পেশায় চিকিৎসক (তিনিও চাকুরি থেকে অবসরে গেছেন) । কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হলো দুজনের লেখার হাত দেখে মনেই হয় না, এরা নিয়মিত লেখক ছিলেন না।আজ আমি লিখছি মো. হুমায়ুন কবিরের ‘বেড়াই ঘুরে দেশান্তরে ‘ বইটি নিয়ে। বলাই বাহুল্য, আমি খুব কম বইয়ের রিভিউ লিখি। কারণ যোগ্যতার অভাব। তবু অনেকটা সাহস করে এ বইটার রিভিউটা লিখে ফেললাম, কারণ লেখককে আমি চিনি এবং জানি আমার ভুল হলে তিনি তা ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখবেন।লেখকের পায়ের নিচে নিশ্চিত সুনীলের মতো সর্ষে আছে অথবা তাঁর হাতের ভ্রমন রেখা অতি দীর্ঘ, নয়তো একজীবনে এত জায়গা ঘুরার অভিজ্ঞতা খুব কম মানুষের হয়। অবশ্য তিনি আলোচ্য বইটিতে ছয়টি ভ্রমন অভিজ্ঞতা লিখেছেন (অন্যগুলো তাঁর ‘আঙিনা পেরিয়ে’ বইয়ে আছে।)নেপাল, পাকিস্তান, ভারত,শ্রীলংকা,স্পেন, মিশর, কানাডা আর মালদ্বীপকে ঘিরেই বইটি পাঁক খেয়েছে।লেখকের গদ্য পড়ে যে প্রশ্নটা আমার মাথায় প্রথম নাড়া দেয়, তা হচ্ছে, সারাজীবন সরকারী চাকুরি করে, নিরস ফাইল চর্চা করে, অবসরে যাওয়ার পর তিনি এ অসাধারণ গদ্যের নিজস্ব স্টাইল আয়ত্ত্ব কীভাবে করলেন? ইট’স জাস্ট অ্যামেইজিং! এখানে এসেই আমার মন কিছুটা খারাপও হয়ে যায়। মনে হয়, তাঁর কলমের এ শক্তি আসলে সব সময়ই ছিল, তিনি তা আবিষ্কার করেছেন বড়ো দেরিতে। আমার ধারণা যদি সত্য হয়, তবে তা আফসোসের ব্যাপার, কারণ দেরিতে শুরু করায় আমরা তাঁর অনেক সৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হয়েছি এবং হবো।ভ্রমন আমিও কিছু করেছি। কিন্তু লেখকের যে বিশাল আদিগন্ত দৃষ্টি থাকা দরকার আমার তা ছিল না বলে, আমি সব দেখেছি উড়ে যাওয়া পাখির চোখে, আর তিনি দেখেছেন স্থির প্রাচীন বৃক্ষের মতো কালদর্শীর চোখে। তাই যা তাঁর কলমে ধরা পড়েছে, তা আমার কালিতে ফুটে উঠেনি।তাঁর লেখা মাঝারি গতির ট্রেনের মতো। এরকম ট্রেনে বসে আপনি যেমন জানালা দিয়ে সব দেখতে পাবেন, কোথায় পুকুরে কে জাল ফেলছে, কোন উঠানে বৌ-ঝিরা ধান মাড়াচ্ছে, কোন গাছে এমন কি কামরাঙা রঙিন হয়ে আছে, কিন্তু তার জন্য থামতে হবে না, ঠিক তেমনি হুমায়ুন কবিরের বই আপনাকে থামাবে না, কিন্তু সব দেখাবে। যে জায়গার বর্ণনা তিনি দিচ্ছেন, তা আপনি উপভোগ করবেন নিজ উপস্থিতিতে, লেখকের চোখে নয়। নিজের কলমে পাঠককে বন্দি করে ফেলার এ দক্ষতা খুব কমই দেখি।আবার কখনো তাঁর বর্ণনায় মনে হয়েছে, একই স্টেশনে আমিই নেমেছি, একই রাস্তায় আমিই ঘুরছি—এ অনুভুতিটি আনা ভ্রমন কাহিনীর সবচে বড়ো চ্যালেঞ্জ। এখানে লেখক সার্থক। কারণ বারবার তিনি পড়ার টেবিল থেকে আমাকে তাঁর বর্ণিত জায়গায় নিয়ে গেছেন।আমাদের ভ্রমন কাহিনীর বড়ো দূর্বলতা হলো, আমরা জায়গা দেখি, মানুষ দেখি না। অথচ ভিন্ন জায়গার ভিন্ন মানুষ দেখার অভিজ্ঞতার তুলনা হয় না। তিনি এ ব্যাপারটি খুব ভালোভাবে খেয়াল করেছেন। তাই তাঁর ভ্রমন শুধু ভূগোলের বর্ণনা নয়, মানুষের কাহিনীও বটে। এদিকটা আসলেও অনবদ্য।আবার অনেকেই এত ইতিহাস বর্ণনা করেন যে, ‘ভ্রমন ‘বিষয়টিই বুদবুদ হয়ে মিলিয়ে যায়। লেখক এটিও ঘটতে দেননি। কোনো জায়গায় গেলে তার বর্ণনা এবং সেখানকার মানুষের বর্ণনাই মুখ্য হওয়া উচিত বলে আমার মনে হয়, ইতিহাস নয়। সেটা আসবে, তবে মূল মেজাজ নষ্ট করে নয়। আমার মনে হয় অযথা পৃষ্ঠা বাড়ানোর জন্য আমরা এটা করি। হুমায়ুন কবির এ লোভ থেকে দূরে থাকার জন্য ধন্যবাদ পেতে পারেন।সব মিলিয়ে আমার বইটি খুবই ভালো লেগেছে।এটি আমি আমার পড়ার তালিকায় সব সময় রাখবো, সব বই এ তালিকায় থাকে না, কারণ একই বই বারবার পড়লে নতুন বই পড়া হবে না।আফটার অল, ফ্রাংক যাপ্পা বলে গেছেন, “টু ম্যানি বুকস, টু লিটল টাইম।”ধন্যবাদ। #আসুনমায়াছড়াই।
বুক রিভিউ: বেড়াই ঘুরে দেশান্তরে।
Badal Syed
- October 12, 2020
- 11:01 am
- No Comments