হাসপাতালের ক্যান্টিনের আলো একধরনের উষ্ণতায় ভর পুর।হালকা হলুদ। ভেতরের সাজ বেশ সম্পন্ন রেস্তোরার মত। ভিড় তেমন নেই। আমরা বসেছি এক কোণায়, সামনা সামনি দুটো নিচু সোফায়, মাঝখানের টেবিলে গরম কফির ধোঁয়া আমাদের মধ্যে একধরণের স্বাচ্ছন্দ্যের দেয়াল তৈরি করেছে। এটার দরকার ছিল।তাঁর সামনে আমার বেশ অস্বস্তি লাগছে।
লাগার কথা। দেশ সেরা সার্জন, তাঁর উপর যে কেউ ডুব দেবেন এমন সৌন্দর্য।
ধোঁয়ার আড়ালেও আমার খুব অস্বস্তি লাগছে। এত খ্যাতিমান তার উপর রূপসী একজন বিদুষী মহিলার সামনে আমি মোটেও স্বাচ্ছন্দবোধ করছি না।এই দামী হাসপাতালের ঝকঝকে কফিশপ আমার জন্য নয়, এখানে চিকিৎসা নেবার কথাও আমার কল্পনার বাইরে।
আমার এখানে আসা পুরোটাই কাকতালীয়।
একটি বেসরকারী কোম্পানীতে কাজ করি, মধ্যম মানের চাকুরী, বেতন ও তাই।ঢাকা শহরে এ বেতনে আলাদা বাসা নিয়ে থাকা অসম্ভব। তাই একজনের বাসায় সাব লেট থাকি। বাড্ডা এলাকায়। যার বাসায় থাকি তিনি কাজ করেন একটি ইন্সুরেন্স কোম্পানীতে।নাম শামসুল আলম। স্ত্রী আর এক মেয়ে নিয়ে সংসার। কিছু বাড়তি আয়ের জন্যই আমাকে সাব লেট দিয়েছেন। তাও দিতেন না, আমার অফিসের মিজান সাহেবের তিনি ভাল বন্ধু, তাঁর মধ্যস্থতায় আমার এ আশ্রয় লাভ। তবে গৃহকর্তাকে মনে হলো জীবন যুদ্ধে পর্যুদস্ত একজন মানুষ । কোন রকমে তিনজনের সংসার টেনে নিয়ে চলেছেন।প্রথম দেখায় বললেন, ভাই আমি অভাবে বাড়ি সাবলেট দিচ্ছি।কিন্তু বাড়ীওয়ালাকে বলবো, আপনি আমার ভাই, কিছুদিনের জন্য এসেছেন। নয়তো এলাউ করবে না, হারামি লোক। তাছাড়া ভাই, বুঝেন তো বউ বাচ্চা নিয়ে থাকি, কথা বলার লোকের তো অভাব নাই। আপনাকে কিন্তু রাত দশটার মধ্যে বাড়ি ফিরে আসতে হবে। এগারোটায় বাতি নিভিয়ে দিতে হবে। আমার ঘুমের সমস্যা, পাশের রুমে হাঁটাচলা করলে বা বাতি জ্বললে ঘুম হবে না। খাওয়ার ব্যবস্থা নাই, বাইরে খেয়ে আসবেন।
আমি সব শর্তে রাজি। শুধু রাত এগারোটায় বাতি নিভানো নিয়ে সমস্যা। রাত জাগার অভ্যেস অনেকদিনের।তারপর ও সব মেনে নিয়ে তাঁর বাসায় উঠলাম। ছোট্ট দু’রুমের ফ্লাট তার মধ্যে একটিতে আমার জায়গা হলো। তখন দুপুর, বেশ ক্ষিদে পেয়েছে, গোসল করে খেতে বেরুবো, এমন সময় ভদ্রলোক এসে বললেন, ভাই সাহেব, আমার স্ত্রী বলছেন, আজ প্রথম দিন আপনি আমাদের সাথে দুপুরে খান, অচেনা জায়গায় হোটেল খুঁজতে সময় লাগবে। আমি বিনয়ের সাথে বললাম, ধন্যবাদ ভাই, তবে সমস্যা নাই, আমি হোটেল খুঁজে নেবো। তিনি বললেন, আমার স্ত্রী আপনার জন্য রান্না করেছেন, সামান্য আয়োজন, আজ আপনি প্রথম আসবেন তাই। আপনি না খেলে সে মনে কষ্ট পাবে, বড় সরল মেয়েছেলে, ভাই।
আমার কেমন জানি খারাপ লাগে, মন খারাপ, একজন অচেনা ভদ্রমহিলা আমার জন্য রান্না করে বসে আছেন, ভাবতেই মন আদ্র হয়ে উঠে।কেবল মেয়েরাই এ মমতা ধারণ করতে পারে।
খেতে বসে দেখি আয়োজন সামান্য নয়, পোলাউ, মুরগির কোরমা, রুই মাছ, সালাদ। মনটা আবার খারাপ হয়ে গেলো।ভদ্রলোকের অবস্থা ভাল নয়, তারপর ও শুধু আমার জন্য——
বললাম, আপনি এটা কী করেছেন ভাইজান, এত আয়োজন!!! তিনি বললেন, নারে ভাই, আপনি মেহমান, কথায় আছে অতিথি নারায়ণ, তাই সামান্য আয়োজন, আমি দরিদ্র মানুষ এর চাইতে বেশি করার ক্ষমতা নাই।
আমার লজ্জা আরো বেড়ে গেলো, না ভাইজান, আমি আসলে অনেকদিন এমন সুখাদ্য খাই নাই,বলতে বলতে প্রায় অপরিচিত এ পরিবারের মমতায় চোখে পানি চলে এলো, চট করে তা লুকিয়ে ফেললাম।
ভদ্রলোক বললেন, আসেন ভাইজান বসি, তবে ভাইজান, আমার স্ত্রীকে ক্ষমা করবেন, তিনি পর্দা করেন, কারো সামনে আসেন না, তাই নিজ হাতে খাওয়াতে পারবেন না।
‘আরে কি বলেন ভাইজান, আমার বোনকে বলেন, আমি অনেক কৃতজ্ঞ।
কথা শেষ না হতেই ভেতর থেকে পাঁচ-ছয় বছরের একটি মেয়ে দৌড়ে আসে। মন ভাল করে দেবার মত ফুটফুটে। ভদ্রলোক তাঁর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেন, মামারে সালাম করো মা দখিনা হাওয়া, তিনি এখন থেকে আমাদের সাথে থাকবেন।
মেয়েটি কিছু বুঝে উঠার আগেই ঠুক করে আমার পা ধরে সালাম করলো, আমি তার মাথায় হাত রেখে বললাম, আম্মা, তোমার নাম বুঝি দখিনা হাওয়া? খুব সুন্দর নাম তো—-
ভদ্রলোক হো হো করে হেসে বললেন, ওর নাম কান্তা, আমি আদর করে ডাকি দখিনা হাওয়া, আপনার বোনের তাতে প্রবল আপত্তি।
হাসতে হাসতে বললাম, আমার বোনকে বলবেন, তাঁর ভাই এর দখিনা হাওয়া নামটা খুব পছন্দ হয়েছে, তিনি ও এই পরীর মত মেয়েকে তাই ডাকবেন।
এবার ভেতর থেকে, খিল খিল হাসি ভেসে এলো, তারপর শোনা গেলো তাঁর কন্ঠ, আপনি আমাকে বোন ডাকছেন, আপনার আদেশ ভাই এর আদেশ, মেয়েরে দখিনা হাওয়া ডাকা যাবে। আবার হাসি।
মনটাই ভাল হয়ে গেলো।
কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে বিকেল নাগাদ উঠেছি, কান্তা এসে হাজির, বড়মামা, মা জিজ্ঞেস করছে, আপনি চা’য়ে চিনি খান কিনা?
আমি শশব্যস্ত হয়ে বলি, দখিনা হাওয়া, তুমি মাকে বলো, আমার জন্য ব্যস্ত হওয়ার কোন কারণ নাই, আমি এখন চা খাবো না, বাইরে যাচ্ছি, সেখানেই খেয়ে নেবো
কান্তা দুহাত নেড়ে নেড়ে মুরুব্বির মত বলে, তুমি তো দুষ্ট আছো বড় মামা, মা তোমাকে চা খেতে বলছে,আর তুমি বলছো খাবে না— মহা দুষ্ট।
আমি কিভাবে এ বাচ্চা মেয়েকে বুঝাই সমস্যা কোথায়?? যাই হোক নিমরাজি হয়ে বললাম, চিনি দুধ দুটোই দিতে হবে।
সে লাফাতে লাফাতে চলে গেলো।
চা খেয়ে বাইরে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে রেস্টুরেণ্ট থেকে খেয়ে এলাম। ফিরে দেখি, ভদ্রলোক বসে আছেন, সাথে কান্তা, বললেন, ভাইসাহেব আসেন রাতে খাওয়া নিয়ে আপনার বোন বসে আছে।
ভাবলাম আর না, এবার ব্যাপারটার অবসান হওয়া উচিত। বললাম, ভাইজান, আমি খেয়ে এসেছি। অনেক তো খেলাম, আর না, বোনকে বলেন, এ কষ্টটা না করলে আমি খুশী হবো।
ভদ্রলোক কিছু বলার আগেই কান্তা কেমন যেন কান্না কান্না কন্ঠে বললো, মা, বড় মামা নাকি খাবেনা—–
ভদ্রলোক মৃদু গলায় বললেন, আমার মেয়ে আপনাকে বড় মামা ডাকছে, কিছু মনে করবেন না, ওর মা শিখিয়েছে, তাঁর বড় ভাই ছিল একজন, লঞ্চডুবিতে মারা গেছে, আপনাকে নাকি তাঁর মত লাগে।
‘না না, আমাকে বড় মামা ডাকলে আমি খুশিই হই।
ভদ্রলোক যেন স্বস্তি পেলেন। কী করবো, আপনার বোন আবদার করেছে, তারে আপনি বোন ডাকছেন, সে আপনাকে বাইরে খেতে দেবে না।
আমার চেহারায় অমত দেখে তিনি আবার বললেন, আমি বুঝি আপনি কেন রাজি হচ্ছে না, আসলেই আপনাকে খাওয়ানোর ক্ষমতা আমার নাই, তবে ভাইজান, আপনি না হয় মাস শেষে কিছু খরচ দিয়ে দেবেন। তাতে আপনার ও খারাপ লাগবেনা, আমার ও সমস্যা হবে না। এবার আসেন ভাইসাহেব, খেয়ে এলেও একটু হলেও কিছু মুখে দেন, নইলে আপনার বোন মন খারাপ করবে, বড় অভিমানী সে।
এভাবে আমি ক’দিনেই তাঁদের একজন হয়ে গেলাম। সবচে’ ন্যাওটা হলো কান্তা। সে ‘বড় মামা” ছাড়া কিছুই বুঝে না।সন্ধ্যে হলেই বই-পত্র নিয়ে হাজির, সে আর কারো কাছে পড়বে না। তাঁর মা ভেতর থেকে বলেন, মা, মামারে বিরক্ত কইরো না, সারাদিন অফিস করছেন, এখন তাঁর বিশ্রাম দরকার। আমি তাড়াতাড়ি বলি, বোন, কোন সমস্যা নাই, ওকে পড়াতে আমার ভালই লাগে। পড়ানো শেষ করে আমাকেই তাঁকে খাওয়াতে হয়। আর কেউ খাবার দিলে খাবেনা। তারপর হাজির হয়, রাজা- রানীর গল্প বই নিয়ে।পড়ে শোনাই। শুনতে শুনতে ঘুম, তারপর তাঁর বাবা কোলে করে বিছানায় নিয়ে যান।
একদিন বাসায় ফেরার সময় তাঁর মা ভেতর থেকে বললেন, ভাইজান, কান্তাকে একটু বুঝান চুল কাটতে, অনেক লম্বা হইছে, গরমে ঘামায় আবার উকুন ও হইছে , সে রাজি হচ্ছে না।
আমি বললাম,কেন কাটবে না?
মা বললেন, মেয়ের এক কথা, বড় মামাকে জিজ্ঞেস করো, উনি বললে কাটবো।
আমার চোখ ভিজে আসে, এমন মমতার ছোঁয়া এই দুনিয়ায় পাওয়া যায় আগে জানতাম না।
অসাধারণ সব দিন কাটে। আমি ছোট বেলা থেকে পরিবার বঞ্চিত, তাই এদের ভালবাসায় কেবল সব কিছু আদ্র হয়ে উঠে।
বিপদ হলো মাস খানেক পর। শামসু সাহেব সেদিন বাসায় নেই। ইন্সুরেন্সের কাজ নিয়ে চিটাগাং গেছেন। ইচ্ছে করেই অনেক রাতে বাড়ি ফিরলাম। ভদ্রমহিলা বাসায় একা, তাই একটু অস্বস্তি হচ্ছে, চেয়েছিলাম কোন বন্ধুর বাসায় চলে যাবো, শামসু সাহেব এক কথায় না করে দিয়ে বলেছেন, আপনার বোন একা থাকতে ভয় পায়, আপনি থাকলে নিশ্চিন্তে থাকি।
খেয়ে দেয়ে অনেক রাতে ঘুমুতে গেছি, আধো ঘুম ভেঙ্গে গেলো আর্ত চিৎকারে। চিৎকার আসছে, পাশের রুম থেকে, কান্তার চিৎকার’ বড় মামা—– বড় মামা—-
ধড়ফড় করে উঠে গেলাম, কী হয়েছে মা, কী হয়েছে? সব কিছু ভুলে আহত পশুর মত ছিটকে বেরিয়ে এলেন তার মা, ভাইজান আমার মেয়েরে বাঁচান, আপনার পায়ে পড়ি।
কিন্তু কী হয়েছে?
উত্তর এলো, পেট ব্যথা, ভয়ানক ব্যথা। ও মারা যাচ্ছে ভাইজান।
আমি কোন কথা না বলে ছুটে গিয়ে কান্তার কাছে গেলাম, অবর্ননীয় ব্যথায় মেয়েটা কাতরাচ্ছে। আমাকে দেখেই আবার চিৎকার, বড় মামা, আমাকে বাঁচাও।
ছাত্র জীবনে আমি একটা ফার্মেসিতে বসতাম, অনেক রোগি দেখার অভিজ্ঞতা আছে, তাই দেখেই বুঝলাম বাচ্চাটির মারাত্নক কোন সমস্যা হচ্ছে, এক্ষুনি হাসপাতাল নিতে হবে।মেয়েটা এক্ষুনি জ্ঞান হারাবে, তা আর ফিরে নাও আসতে পারে। আমি মূহুর্ত দেরি না করে ওকে কোলে তুলে নিলাম, তারপর এক ছুটে নিচে নেমে এলাম, পেছন পেছ্ন তার মা। এক্ষুনি একে হাসপাতালে নিতে হবে। রাস্তায় নেমেই একটি সি এন জি পেলাম, বললাম, ভাই আশে পাশে কোন হাসপাতালে নিয়ে যান, যত তাড়াতাড়ি পারেন।
সি এন জি ওয়ালা নিয়ে গেলো ইউনাইটেড হাসপাতালে,এত বিপদের মাঝেও মনে হলো, এটা কী হলো? এ হাসপাতালে চিকিৎসা নেবার ক্ষমতা কান্তার বাবার নেই। কিন্তু মেয়েটি জ্ঞান হারিয়েছে, তার মাও অনবরত কাঁদছেন, তাঁর সিদ্ধান্ত নেবার মত মনের অবস্থা নেই। মনে পড়লো প্রভিডেন্ড ফান্ডে অনেক কষ্টে লাখ তিনেক টাকা জমিয়েছি। চিন্তা করলাম, দরকার হলে তা খরচ করে ফেলবো, আগে বাচ্চাটিকে বাঁচাতে হবে।
ইমার্জেন্সির ডাক্তাররা অবস্থা দেখে ভরকে গেলেন। এপেন্ডিক্স সমস্যা, এক্ষুনী অপারেশন লাগবে। তাঁরা খবর দিলেন সার্জনকে। তিনি যখন এলেন, তখনো তাঁর চোখের পাতায় কিছুটা ঘুম, চেহারায় ক্লান্তি, কিছুটা বিরক্ত ও মনে হলো। আগেই বলা ছিল ওটি ঠিক করে রাখতে, ডাক্তার ভদ্র মহিলা একটু দেখেই বললেন, মুভ ,ওটি, কুইক। এর মধ্যে কান্তা র জ্ঞান ফিরে এসেছে, আমি তার হাত ধরে আছি। অপারেশন থিয়েটারে ঢুকার আগে জোর করে আমার হাত ছাড়াতে হলো। শেষ মুহুর্তে সে চিৎকার করে উঠলো, “বড় মামা———
ঠিক সময়ে চিকিৎসা হলে এপেন্ডিক্স বড় কোন সমস্যা নয়, সমস্যা হলো বিল নিয়ে। এর মধ্যে কান্তার বাবা ফিরে এসেছেন, তিনি আমার হাত ধরে একদিকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন, আবার অন্যদিকে গভীর সমুদ্রে পড়েছেন। দেড় লাখ টাকার মত বিল এসেছে। কোত্থেকে দেবেন। তাঁকে উদ্ভ্রান্ত মনে হয়, একজন বাবার উদ্ভ্রান্ত অসহায় মুখের মত মন খারাপ করা দৃশ্য আর কিছু নেই। আমি তাঁকে এক কোণায় ডেকে নিয়ে বললাম, রআপনি আর আপনার স্ত্রী আমাকে ভাই ডেকেছেন, সে দাবিতে বলছি, আমার কাছে কিছু টাকা আছে, আপাতত বিলটা আমি দিয়ে দিচ্ছি, পরে যা হয় দেখা যাবে।
শামসু সাহেব ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠলেন, ভাইজান আপনি কই পাবেন??
সেটা আমি বুঝবো, আপনি শুধু না করবেন না।
তিনি আবার ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগলেন। সাথে তাঁর স্ত্রী ও।
অসহায় চোখে তাঁকে দেখছি, এমন সময় হাসপাতালের এক এটেন্ডেন্ট এসে একটা চিরকূট দিয়ে বলেন,জিনাত ম্যাডাম দিয়েছেন। আপনাকে।
অবাক হলাম। জিনাত ম্যাডাম মানে কান্তাকে যিনি অপারেশন করেছেন। কঠিন একজন ভদ্রমহিলা হিসেবে হাসপাতালে তাঁকে সবাই বাঘের মত ভয় পায়। তিনি আমাকে লিখেছেন??? ভুল হচ্ছে নাতো।
না, ভুল হয় নি। তিনি লিখেছেন, ভাই সালাম,যদি সময় হয়, আজ সন্ধ্যা ছ”টায় ক্যাফেতে আমার সাথে কফি খেলে খুশী হবো।আপনার সাথে একটু একা কথা বলতে চাই।
এবার অশুভ আশংকায় বুক কেঁপে উঠলো, কান্তার কোন খারাপ খবর দেবেন নাতো?
এখন আমি তাঁর সামনে বসে আছি। তিনি কফিতে হাল্কা চুমুক দিয়ে বললেন, আপনি মেয়েটির মামা?
উত্তর দিলাম, হ্যাঁ, কিন্তু কেন?
আপন মামা??
অনেকটা তাই?
তার মানে আপন মামা নন।
না, আমি তাঁদের বাসায় সাব লেট থাকি, মেয়েটি আমাকে মামা ডাকে।
তাই? আপনি দেখলাম হাসপাতালে এক সপ্তাহ সময় দেবার আবেদন করেছেন, লিখেছেন, আপনার প্রভিদেন্ড ফান্ড থেকে লোনের আবেদন করেছেন, মঞ্জুর হলে বিল দেবেন।আপনার গ্যরান্টর হয়েছেন আপনার কোম্পনির একজন বড় মাপের কর্মকর্তা।কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কেন??? মেয়েটির বাবা না করে আপনি করছেন কেন??
“তাঁর পক্ষে কোনভাবেই দেয়া সম্ভব নয়, তাই আমি ব্যবস্থা করছি।
তিনি আবার কফিতে চুমুক দিলেন, তাঁর অনামিকায় ঝলসে উঠলো আংটি, মনে হয় হিরে। বললেন, অদ্ভুত, বড় অদ্ভুত।
তারপর আবার হাসলেন, জানেন, আমি বড় হয়েছি আমার বড় মামার কাছে।
আমার চোখে কৌতুহল জেগে উঠে।
তিনি ঝুঁকে আসেন,আমার অস্বস্তি লাগে।ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে তিনি বলতে থাকেন, আমার বড় মামা ছিলেন নিষ্ঠুর টাইপ মানুষ। পাঁচ বছর বয়সে বাবা হারানোর পর আমার মা তাঁর আশ্রয়ে যান। আমি সহ। মামা এতে খুব বিরক্ত ছিলেন। হওয়ারই কথা। তাঁর নিজের হত দরিদ্র অবস্থা। রেলওয়ের কেরানি। নিজের চার বাচ্চা, এমনিতেই হিমশিম খান, সেখানে আরো দুটো অতিরিক্ত পেটের দায়িত্ব নিতে কারোই ভাল লাগে না।
মজার ব্যাপার হলো, কেন জানি তাঁর সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল আমার উপর। আমাকে দেখলেই তাঁর মাথায় আগুন ধরে যায়।মাঝে মাঝে অযথা মারতেন।আমার মা আমাকে বুকে চেপে কাঁদতেন। তবে সহায় ছিলেন মামি। তিনি প্রায় আমাকে জড়িয়ে ধরে বলতেন, আম্মা, মন খারাপ করিসনা, অভাবে মানুষটার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, তার মনটা কিন্তু নরম, দেখায় না। আমি মামির বুকের গন্ধ নিয়ে কাঁদতাম, তবে মামার প্রতি আমার ঘৃনা তাতে কমতোনা।
এ ঘৃনা আর বেড়ে গেলো ক্লাশ এইটে উঠার পর। মামা আমাকে বিয়ে দেবার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন। অথচ আমার পড়ার খুব শখ। রেজাল্টও দুর্দান্ত।ক্লাশ ফাইভে আর এইটে বৃত্তি পেয়েছি। স্যাররা বলছেন এস এস সিতে প্লেস থাকবে। আর বড় মামা পাগল হয়ে গেছেন আমাকে বিয়ে দিতে। কোত্থেকে রাজ্যের অদ্ভুত প্রস্তাব আনেন।মাঝ বয়সী, বিপত্নীক এমন কী একবার আনলেন এক পত্রিকা হকারের সাথে বিয়ের প্রস্তাব। আমি অনবরত কাঁদতে থাকি। মা ভয়ে তাঁকে কিছু বলেন না। ভরসা মামি। তিনি প্রতিবার কঠিন ভেটো দেন আর মামার রাগ আর তুঙ্গে উঠে।তিনি গর্জান, নবাবের বেটি হইছে, বিয়া করবে না, এদিকে নবাব হারামজাদা আমার উপর স্ত্রী- কন্যার পাহাড় তুলে দিয়ে কবরে গিয়া ঢুকছে। আমার ইচ্ছে করে ছুটে গিয়ে তাঁর মুখ চেপে ধরি, বলি, প্লিজ মামা, মরা মানুষকে গালি দিতে নেই।সাহস হয় না।
তিনি কিছুটা হাঁপাচ্ছেন, এতক্ষণ ঝুলে থাকা হাসি কখন যেন বিদায় নিয়েছে, এখন সেখানে ঝুলছে তীব্র বেদনা।
এমন করতে করতে কিভাবে যেন এইচ এস সি পাশ করে ফেললাম। এস এস সি আর এইচ এস সি দুটোতেই প্লেস ছিল। ফিফথ আর নাইন্থ।
কিন্তু মামা ঘোষণা দিলেন, আর নয়, এবার বিয়ে তিনি দেবেনই। তাঁর আর একদিনও আমাকে পড়ানোর ক্ষমতা নেই। এর মধ্যে আমার কলেজের এক ম্যাডাম, আমার অবস্থা জানতেন, খুব স্নেহ করতেন। তিনি একবার আমার সি ভি আর সব একাডেমিক পেপার নিয়েছিলেন।কেন তাও জানি না। শুধু বলেছিলেন, দরকার আছে।
সব জায়গায় ভর্তি হওয়ার সময় চলে যাচ্ছে, আমি মামার ভয়ে এপ্লাই করতে পারছি না। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ভাল পাত্র পাওয়া গেছে, আমাকে বিয়ে দেবেনই। পাত্রের বাজারে মুদি দোকান আছে, বেচাকেনা ভাল।কোন দাবী দাওয়া নাই।তারা শুধু লেখাপড়া করা মেয়ে চায়, কারন ছেলে নাইন পাশ। এমন সুযোগ নাকি লাখেও আসে না।
আমার পৃথিবী তখন অন্ধকার। কী করবো জানি না। এমন সময় একদিন কলেজের পিয়ন সিরাজ ভাই এসে জানালেন, আমাকে সেই ম্যাডাম ডেকেছেন। শিরি ম্যাডাম। তিনিই আমার কাগজপত্র নিয়েছিলেন।
যাওয়ার পর তিনি আমার মাথায় অনেকক্ষণ হাত বুলালেন, তারপর বললেন, আমার এক ভাই আমেরিকার জন হপকিন্স মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। আমি তার কাছে তোমার কাগজপত্র পাঠিয়েছিলাম। তোমার ওখানে এডমিশন হয়েছে।ফুল স্কলারশীপ দেবে ওরা। সমস্যা একটাই প্লেন ভাড়া তোমাকে দিতে হবে। ষাট হাজার টাকার মত লাগবে, সাথে দরকারি খরচের জন্য ধরো আরো হাজার বিশেক। পারবে জোগাড় করতে?
আমার দুনিয়া ঘুরে উঠলো, আনন্দে। তারপর তা ছেয়ে গেলো তীব্র বিষাদে। এ টাকা জোগাড় করা আমার কল্পনারও বাইরে। আমি কিছুই উত্তর দিলাম না। শুধু কাঁদতে লাগলাম। শিরি ম্যাডাম বললেন, আমি জানি মা, এ টাকা তুমি দিতে পারবে না। আমার থাকলে আমিই দিতাম, কিন্তু বিধবা মানুষ এত টাকা কই পাবো বলো??
কিছুই না বলে তাঁকে সালাম করে বাড়ি ফিরে এলাম। মায়ের পাশে বসে শুধু কাঁদছি। তিনিও বুঝতে পারছেন না কী হয়েছে? জবাবও পাচ্ছেন না। একটু পর মামি এলেন, তিনি যখন জড়িয়ে ধরে বললেন, পরি মাগো, বল তো কী হয়েছে? লক্ষী মা না তুই?
এবার আর পারলাম না, হু হু করে কাঁদতে কাঁদতে সব বলে দিলাম।
তিনি কিছুই বললেন না। শুধু আমার সাথে কাঁদতে লাগলেন।
রাতে খাওয়ার পর বড় মামা আমাকে ডাকলেন, আমি ভয়ে থরথর করে কাঁপছি। তিনি কি কোনভাবে ব্যাপারটা জেনে গেছেন? এখন কী আমাকে ঝাড়ুর শলা দিয়ে পিটাবেন?? এতো বড় হয়েছি। কিন্তু তাঁর মার বন্ধ হয় নি। আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে। শুধু মরে যেতে ইচ্ছে করে।
যেতেই তিনি বললেন, তুই নাকি আমেরিকা যাইতে চাস, পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে—পড়ছস এইটা?
আমার তীব্র অপমান লাগে, এই প্রথম আমি তাঁর কথার পিঠে বলে উঠি, না বড় মামা, আমি যাইতে চাই না, ওরা একটা স্কলারশীপ দিছে।
প্লেন ভাড়া তো দেয় নাই, ফকিরনির পুতেরা। কত টাকা লাগে জানস??
আমি বললাম, মামা আমি তো যাবো না।
মুখে মুখে কথা, থাবড়া দিয়া— বলতে বলতে তিনি হাত তুলে এগিয়ে আসেন।
আমি তাড়াতাড়ি মার থেকে বাঁচার জন্য বলি, আশি হাজার টাকা।
তিনি থমকে যান। আ—-শি– হা—জা—র– টা—কা? এরাতো ফকিরনির পুত না, পুরাই “আজান’ ডাকাইত। সুন্দরবনের আজান ডাকাইত।
আমি আবার বলি, বড় মামা আমি তো যেতে চাইছি না।
তিনি ধপ করে মোড়ায় বসলেন, কিছুক্ষণ মাটির দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর মুখ তুলে বললেন, কাল শিরি ম্যাডামরে গিয়া কইবি, টাকার ব্যবস্থা হবে, তুই যাবি।
ভুত দেখলেও এমন আর্তচিৎকার বেরুতো না, মামা, আমি যাবোনা—– এত টাকা—
আরেকটা কথা কইলে ঝাড়ু দিয়া পিটাইয়া লাল কইরা দিব। আমি প্রভিডেন্ড ফান্ড ভাঙ্গাবো, এত বড় একটা সুযোগ, তিন বংশে কেউ পায় নাই, আর হারামজাদি বলে যাবে না—- সাহস, কত বড় সাহস—- বলতে বলতে তিনি হঠাৎ উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন, মা, মারে তোরে আমি প্রাণের অধিক ভালবাসি। কিন্তু দরিদ্র মানুষের আদর দেখানো পোষায় না। আমি সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকতাম এতো সুন্দর এই পরির মত মেয়েরে নিয়া আমি কী করি? এরে আমি রক্ষা করতে পারবো তো? গরিবের মেয়ে হওয়ার অনেক বিপদ মা। তাই তোরে সব সময় বিয়া দিতে চাইতাম। এই সব ভাবনায় নিজের উপরই রাগ হইতো, অক্ষমতার উপর রাগ, সেটাই আমি তোর উপর ঝাড়ছি মা, মারে——
ভদ্রমহিলা পরিষ্কার কাঁদছেন।
আমি আমেরিকা যাওয়ার এক বছরের মাথায় বড় মামা মারা যান। আমার তাঁর জন্য কিছুই করা হয় নি। সেদিন কান্তা যখন আপনার হাত ধরে ডাকলো, “বড় মামা”, আমি অনেকদিন পর আমার বড় মামাকে দেখতে পেলাম। তিনি হাসছেন।
তারপর হঠাৎ একদম আমার পাশে এসে বসলেন, ফিসফিস করে বললেন, বড় মামা, আমি না বলে একটা কাজ করে ফেলেছি। কান্তার হাসপাতালের বিলটা দিয়ে দিয়েছি। আমাকে ক্ষমা করবেন।
আমি কিছুই বলছি না, বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।
এরপর কঠিন হৃদয় ডাক্তার ভদ্র মহিলা সবাইকে অবাক করে দিয়ে আমার হাত ধরে ডাকতে লাগলেন, বড় মামা, বড় মামা—-