কালাম ভাই আমার খুব প্রিয় মানুষ।
ভদ্র, স্বজ্জন,শিক্ষিত।
কিন্তু কেন জানি ভাগ্য তাঁকে বিপদে ফেলে বারবার।
মোটামুটি ভাল বেতনে ব্যাংকে কাজ করেন, কিন্তু স্বচ্ছলতা আসেনা।ফালতু খরচ ইনকাম গিলে ফেলে।
ঈদে বোনাস পেলেন, দেখা গেলো মেয়েটার ডেংগু জ্বরের কারণে হাসপাতাল সে টাকা খেয়ে ফেলেছে।
কালাম ভাইকে নতুন পাঞ্জাবি, ভাবির শাড়ি বিসর্জন দিতে হয়।
সিনসিয়ার কর্মী, কিন্তু প্রোমোশন কেন জানি আটকে যায়।
এত কাজ করেন তারপর ও ম্যানেজার কেন জানি তাকে পছন্দ করেন না।
তাই প্রোমোশন, ইনক্রিমেন্ট সব বরবাদ হয়।
একবার রাস্তায় মিছিলের পাশে হাঁটছিলেন, কারো কিছু হলো না, শুধু কালাম ভাই এর মাথায় আচমকা ঢিল পড়ে টানাটানি অবস্থা।
শেয়ার বাজারে গিয়েছিলেন, গামছা কেনার টাকা ও লাভ হয় নি, যা হয়েছে তা হলো আম ছালা সবই বাজারের অতল রহস্যে গায়েব হয়ে গেছে।
এতো ভাল মানুষ কিন্তু এতো ভারি রাশি!!!
কালাম ভাই এর মন সব সময় খারাপ থাকে।
তিনি আফসোস করেন “ভাইরে, কোথাও কোন ভুল হচ্ছে, বড় গুনাহ হচ্ছে, তাই আল্লাহতালা শাস্তি দিচ্ছেন। প্রতিদিন তাহাজ্জুদের নামাজের সময় কাঁদি আর বলি ” মাবুদ, আমার ভুল কোথায় হচ্ছে দেখিয়ে দাও ———–“
অনেকদিন তার সাথে যোগাযোগ নেই।আমি ঢাকা বদলি হয়ে গেলাম। ফোনেও যোগাযোগ হয় না।
কয়েক বছর পর আবার চট্টগ্রাম বদলি হয়ে এসেছি। হঠাৎ একদিন কালাম ভাই হাজির।তাঁকে উৎফুল্ল দেখাচ্ছে।পরেছেন কালো প্যান্টের সাথে আকাশ নীল শার্ট। পলকা ডটের মানানসই টাই।
হাল্কা সুবাস।
খেয়াল করলে বোঝা যায়, শ্যানেল ব্লু।
হাসতে হাসতে বললেন অবাক হচ্ছেন ভাইজান?
অবাক হওয়ার কিছু নেই।উপরওয়ালা দয়া করলে সব ঠিক হয়ে যায়।আমি এখন সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট।চিটাগাং এর এরিয়া চীফ। মেয়েটা ও ডাক্তারি পড়ছে, ছেলেটা বুয়েটে।”
আমি হাত বাড়িয়ে বললাম “কনগ্রাটস।কিন্তু——-
তিনি কথা কেড়ে নিয়ে বললেন ” ভাবছেন কীভাবে সব ফাড়া কেটে গেলো?
আসলেই আমি কিন্তু তাই ভাবছি।
কালাম ভাই বলতে লাগলেন,শুনুন তাহলে, তিন বছর আগে গ্রামে গিয়েছি ঈদ করতে।আমি হচ্ছি মা অন্তপ্রাণ।কিন্তু ঝামেলার কারণে তাঁর কাছে যাওয়া হয় না। প্রতি ঈদে ভাবি যাবো, যাওয়া হয় না। তাঁকে আমাদের সাথে থাকতে বললেও থাকেননা।শহর নাকি ভালো লাগে না, লোকজন কম, উঠানে হাঁটার জায়গা নেই, বন্দী, বন্দী লাগে। তাই নিয়ে এলেও আবার গ্রামে ফিরে যান, কিন্তু যাওয়ার সময় যতদূর দেখা যায়, দেখি কাঁদছেন।আমিও কাঁদি।ইচ্ছে করে তাঁকে জোর করে রেখে দেই।পারি না, তা ছাড়া আপনার ভাবীর ব্যাপারটা ও মাথায় রাখতে হয়।বুঝেনই তো—-
তারপর সেবার ঈদে বাড়ি গিয়ে চমকে উঠলাম।তিনি অসুস্থ জানি, কিন্তু এত খারাপ জানতাম না।বুক ফেটে কান্না এলো। যাই হোক, দেখতে দেখতে ছুটি শেষ, আমার মাকে ফেলে আসতে ইচ্ছে করে না।কিন্তু আসতেই হবে, সামনে প্রোমোশনের মিটিং, আর ইচ্ছে করলেই তো সাথে আনা যায় না, বুঝেনই তো———
আমি একা লুকিয়ে চোখ মুছি, মনে হয় মাকে এক লহমায় কোলে নিয়ে দৌঁড় দেই, আমার বাসার দিকে, কিন্তু পারি না। বুঝেনই তো ———
কালাম ভাই এর কন্ঠ আদ্র হয়ে আসছে
যেদিন চলে আসবো সেদিন আপনার ভাবী একটা অদ্ভুত কাজ করলেন। মা এর পায়ের কাছে বসে বললেন “এই আমি বসলাম, যতক্ষন না আপনি পার্মানেন্টলি আমাদের সাথে যাওয়ার জন্য রাজি হচ্ছেন,ততক্ষণ আমি উঠবোনা।আপনি এখানে বিছানায় পড়ে থাকবেন আর আমরা শহরে আরাম করবো? গুষ্টি মারি সেই আরামের।”
দেখলাম, মা হাসছেন, না, না কাঁদছেন।ভাইরে, কান্না আর হাসির এমন মিশ্রন না দেখলে বুঝবেন না এটা কেমন পবিত্র ছবি।
তারপর থেকেই যাদু, শুধু যাদু।
প্রোমোশন, এরিয়া ম্যানেজার, বোনাস, মাইনে বৃদ্ধি,
মেয়ের ডাক্তারি, ছেলে বুয়েটে,মরা শেয়ার লাফ দিলো তাজা মাছের মত—–
আসলে বুঝলেন ভাই, গ্রাম থেকে মা যখন বলেন, তাঁর শহর ভাল লাগে না, বাড়ির উঠান ছেড়ে তিনি আসবেন না – আসলে তিনি মিথ্যে বলেন।যদি ছেলে বা তার বউ রাখতে না চায়, বিরক্ত হয়, সে ভয়ে।
আসলে মায়ের কাছে ছেলের বুকের মত বড় উঠান, বড় গ্রাম আর কোথাও নেই।
একদম নেই।
আর ছেলের জন্য মায়ের মত বটগাছ আর নেই।
কোন বিপদ সে গাছের ছায়ার নীচে আসতে পারেনা।
আসলেই পারেনা রে ভাই, আসলেই না।
মুশকিল আসান মানেই মা, ভাই, মুশকিল আসান মানেই মা——
কালাম ভাই কাঁদছেন।
শব্দ করে কান্না।
বাচ্চাদের মত।
একদম বাচ্চাদের মত।