মিশন একম্পলিসড!!

১৯৯১ সাল।২৯ এপ্রিল।
প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে চট্টগ্রাম প্রায় ধুলিস্মাৎ হয়ে গেছে।
সমুদ্র থেকে লাশ ভেসে আসছে অগণিত।
ঠিক এসময় একটি বিশ্ব সংস্থা এলো ত্রাণ কার্যে।
তাঁদের কাজে সহায়তা দেয়ার জন্য স্থানীয় কিছু তরুণকে তাঁরা রিক্রুট করলেন।ঘন্টায় সত্তর টাকা বেতন।
তরুণদের নেতা বাম রাজনীতি করেন।তিনি বিনয়ের সাথে বেতনের প্রস্তাব প্রত্যাখান করলেন।বললেন,বিপর্যস্ত মানুষেরা আমাদের ভাই-বোন। আমরা তাদের জন্য কাজ করে টাকা নিতে পারি না।
বেতন ছাড়াই তারা কাজ শুরু করলো।
প্রথম দিন থেকেই নির্লোভ এ তরুণের দলের সাথে বিদেশীদের বাংলাদেশী কো অর্ডিনেটর চূড়ান্ত বাজে ব্যবহার করতে লাগলেন। যেন তাঁরা চাকর নিয়োগ দিয়েছেন। ত্রাণ বিতরণে সামান্য দেরি হলেই যা ইচ্ছে তা বলতে লাগলেন।কথায় কথায় ‘এফ’ অক্ষর দিয়ে গালি দেন,যা বাংলাদেশের ভদ্রসমাজে উচ্চারণ নিষিদ্ধ।
তরুণের দল তারপরও মুখ বুজে সব মেনে নিলো।আর যাই হোক,এরা এসেছেন তাদের দেশের মানুষের সেবা করার জন্য।তাই গালমন্দ করলেও তা মেনে নিতে হবে।
দলের বিদেশীদের সাথে অভিজ্ঞতা কিন্তু ভাল। সমস্যা দেশী সাহেবকে নিয়ে।
যাই হোক,তরুণদের দলটি টু শব্দ না করে কাজ করে যেতে লাগলো।
কিন্তু একদিন ভদ্রলোক সহ্যের শেষ সীমা ছাড়িয়ে গেলেন।
সেদিন সকালে,ধারণা করা হচ্ছে আগের রাতে ‘ত্রাণ কার্যে’ অতি ক্লান্ত হয়ে তিনি সামান্য ‘দ্রাক্ষা রস’ পান করেছেন। সে কারণে চোখ লাল,শরীর কম্পমান।
তিনি তরুণেরা কাজে রিপোর্ট করতেই বললেন, আমার কাছে খবর আছে তোমরা ত্রাণ সামগ্রী বাড়ি নিয়ে যাও,ঠিক মতো দাও না—–এরপর এ রকম হলে খবর আছে।
ত্রাণ কর্মীদের দলনেতা,তিনিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র- তাঁর মাথায় বাজ পড়লো।
এ লোক বলে কী!
তিনি হচ্ছেন শহরের অন্যতম সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান।কেবল মানবতার ডাকে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে কাজ করতে এসেছেন।
তাঁর অপমানে প্রায় কেঁদে ফেলার অবস্থা।কোন কথাই বলছেন না।
মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন।
দলে ছিল গাঢ় কৃষ্ণ বর্ণের রোগা-সোগা এক তরুণ।
কিন্তু তার মেজাজ ছিল নগর বিখ্যাত।
বদরাগী কবিতা লেখার জন্য নাম বা দুর্নাম কুড়িয়েছে।
সে কোন কথা না বলে মদ্যপ কো- অর্ডিনেটরের কাছে গিয়ে বললো, আপনি যদি আমাদের কাছে ক্ষমা না চান, সারা চট্টগ্রামের সব ভলান্টিয়ার এই মূহুর্তে ক্যাম্প ছেড়ে চলে যাবে।ওয়ার্ড অব অনার।আমরা মাগনা খেটে মরছি,আর আপনি মুফতে মদ খেয়ে আমাদের চোর বলেন! মাফ চান, হাত জোড় করে চান— নইলে খবর আছে।প্রথম দিন থেকে কী ব্যবহার করছেন? মানবিক কাজ,নয়তো এই গরমে যে টাই পরে বসে আছেন,তা গলায় পেঁচিয়ে ধরতাম।আমাদের এটিকেইট শিখান,আর নিজে নিরন্ন মানুষের কাছে বসে আছেন টাই পরে! উজবুক– মাফ চান,এক্ষন চান—-
ক্যাম্পে মহা হুলুস্থুল। উপস্থিত সবাই তরুণের পক্ষে।
শেষ পর্যন্ত কো-অর্ডিনেটর তো বটেই, বিদেশী সাহেবও এসে মাফ চেয়ে মিটমাট করলেন।
গন্ডগোল মিটে যাওয়ার পর রোগা ছেলেটি দেশী সাহেবকে বলে এলো, শুনেন,একদিন এই আমি আপনার বসের বস,তাঁর বসের বস যিনি তাঁর সাথে চা খাবো। এ দেশে না,আপনার হেড কোয়ার্টারে। ঠিকানা দেন,সেদিন জানিয়ে দেবো।ওয়ার্ড অব অনার।
সাহেব চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেন।কোন জবাব দিলেন না।

ঠিক ২৫ বছর পরের ঘটনা।
২০১৬ সালে কো-অর্ডিনেটর ভদ্রলোকের বস নয়, স্বয়ং ওই সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তা ঘন কালো, রোগা খ্যাপাটে ছেলেটিকে একটি বিশেষ অধিবেশনে সমাপনী বক্তব্য দেয়ার জন্য নিউ ইয়র্কে তাঁদের হেড কোয়ার্টারে উড়িয়ে নিয়ে গেলেন।
চার মিনিটের বক্তব্যের জন্য তাঁরা তাকে খরচ দিলেন আট লাখ টাকা।
মানে প্রতি মিনিট বক্তৃতার জন্য দুই লাখ টাকা!
সমস্যা হচ্ছে সেই কো-অর্ডিনেটরের ঠিকানা না থাকায় তাঁকে এ খবর জানানো হয়নি।