রোজাবেল, মা, তোকে বলছি- শেষ পর্ব।
দুপুরে রোজাবেলের রুমে গিয়ে দেখি সে শুয়ে আছে। আমাকে দেখেই বললো, “বাবা, আজ তোমার মোরাল প্যারেন্টিং শেষ হবে তাই না।?””হ্যাঁ মা।””তোমার কি মন খারাপ?””প্রতিটা লেখা শেষ হওয়ার পর মন খারাপ হয় মা। চরিত্রগুলো একে একে বিদায় নেয়। মনে হয় খুব আপন কেউ চলে গেলো। আর দেখা হবে না।””কিন্তু এক্ষেত্রে তো তা হবে না। আমি তো আছি, তোমার সামনেই আছি।”আমি শক্ত করে ওকে জড়িয়ে ধরে বলি, মা, শেষ গল্পটা বলি?””না, বাবা।””মানে?” আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি।”এতদিন তুমি আমার কাছে কী চাও তা বলেছ, আজ আমি বলবো তোমার মেয়ে তোমার কাছে কী চায়? মাঝে মাঝে বাবাদেরও উপদেশ শুনতে হয়। অপ্রিয় হলেও শুনতে হয়।”আমি অবাক হয়ে বলি, আচ্ছা বল মা।”তোমার কিছু ব্যাপার আমার ভালো লাগে না।””তাই নাকি? কী ভালো লাগে না?”অনেক কিছুই বাবা, একেক করে বলি, শুনো,১.তুমি সবসময় দাদু ভাই এর ঠান্ডা মেজাজের কথা বলো। কিন্তু তুমি নিজেই মাঝে মাঝে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারো না। তুমি তোমার বাবার ব্যক্তিত্বের কথা বলো, গর্ব করো, কিন্তু তা পুরোপরি ধারণ করো না, এটা ঠিক না।২. বাসায় মেহমান আসলে হঠাৎ তুমি তাঁদের দিকে মনোযোগ হারিয়ে ফেলো। কী যেন নিজের মনে ভাবো, বা উঠে যাও। যদিও আবার ফিরে আসো। কিন্তু এটা খুবই অনুচিত। অতিথি ‘নারায়ণ ভব’- অতিথি দেবতা, এটা তুমিই বলো। সেক্ষেত্রে তাঁদের দিকে পূর্ণ মনোযোগ না কি ঠিক বাবা ?৩. কারো উপর বিরক্ত হলে তা তোমার হাবভাবে প্রকাশ পায়, এটা ঠিক না। তাঁর কথায়ও যুক্তি থাকতে পারে, সেটা পছন্দ হলো না, আর তুমি বিরক্তি প্রকাশ করে ফেলো। এটা অন্যায়। তুমি ঠান্ডা মাথায় তোমার পাল্টা যুক্তি দাও, তাতে তো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বিরক্তি প্রকাশ করা উচিত নয় বাবা।৪. তুমি প্রায়ই সামাজিক অনুষ্ঠানে যাও না। এটার সাথে আমি একমত না। যারা দাওয়াত দেন, তাঁরা ভালোবেসে দাওয়াত দেন। এ ভালোবাসা ইগনোর করাটা অনুচিত। দশ মিনিটের জন্য হলেও তোমার যাওয়া উচিত। ভালোবাসা কিন্তু খুব দামি বাবা, এটার অমর্যাদা করা একদম অনুচিত।৫. তুমি খুব কম হাসো। বাট মাইন্ড ইট, স্মাইল উইনস, অলওয়েজ। তোমার গম্ভীরভাব হৃদয়ে যে সমুদ্রকে তুমি ধারণ করো তা লুকিয়ে রাখে। ইউ সুড স্মাইল বাবা, মোর স্মাইল। ৬. তোমার মধ্যে অহংকার নেই, আই লভ দ্যাট। তবে তোমার মধ্যে অ্যারোগ্যান্সও আছে। এটা তোমাকে কাটাতে হবে বাবা।৭. তুমি চাও সব তোমার মতো হোক। তুমি বই পড়ো তাই অন্যেরও তা করা উচিত। তুমি টিভি দেখো না,তাই কারো তা দেখা চলবে না। তুমি ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠো, তাই অন্যকেও উঠতে হবে। কিন্তু বাবা, তোমার যেমন ভোর ভালো লাগে, তেমনি আমার মাঝরাতের নির্জনতা ভালো লাগতে পারে। যার পছন্দ তার। সেটা তোমার সাথে নাও মিলতে পারে। এটা তোমাকে মানতে হবে।৮. তোমার বন্ধু তোমার জেদ, আবার তোমার সবচে বড়ো শত্রুও তোমার জেদ। এটা তোমাকে বুঝতে হবে।মাঝে মাঝে কম্প্রোমাইজ করতে হয়। তুমি বলো আমি জেদি। কিন্তু এটা তো আমি তোমার কাছ থেকে শিখেছি তাই না?৯. তুমি মানুষকে ভালোবাসো, আবার পছন্দ না হলে যে কাউকে পাত্তা না দেওয়ার অভ্যেসও তোমার আছে।এটা ঠিক না বাবা। যাকে আজ পছন্দ হচ্ছে না, তার গুণের কথা তুমি হয়তো জানো না। মলাট দিয়ে বই বিবেচনা করা কি ঠিক? ভেতরটা পড়তে হবে না?১০. বাবা, আমি কিন্তু তোমার উপদেশ অনুসরণ করবো না, উদাহরণ অনুসরণ করবো। এটা তোমার নিজের কথা, কিন্তু তুমি নিজেই তা মাঝে মাঝে ভুলে যাও।১১. সবচে ইমপরট্যান্ট হলো, তুমি পাঠকদের অবশ্যই ক্লিয়ার করবে, তাঁরা যাতে ‘মোরাল প্যারেন্টিং’ পড়ে আমাকে একদম আদর্শ মেয়ে না ভাবেন। যেন এটা মনে না করেন যে, আমি তোমার সব কথা শুনি। এতদিন এ সিরিজ পড়ে তাঁদের এ ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। এ মিথ্যে ধারণা দূর করা তোমার দায়িত্ব। লেখক হিসেবে পাঠককে তুমি বিভ্রান্ত করতে পারো না। এটা তাঁদের বিশ্বাস হত্যার শামিল।আমি চুপচাপ আমার মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছি। তার চেহারা যেন আয়না, সেখানে নিজের ‘ভুল’ চেহারা দেখতে পাচ্ছি। ভুলের কাটা দাগে ভর্তি চেহারা।
(লেখাটি শেয়ার করা যাবে। এ সিরিজটি বই হিসেবে প্রকাশ করা ঠিক হবে কি না মতামত দিলে কৃতজ্ঞ থাকবো।)
Comments
Most relevant