বাদল সৈয়দ - Badal Syed

রোজাবেল, মা, তোকে বলছি -০১

রাত অনেক হয়েছে। আমার রাজকন্যা খুব ক্লান্ত। সারাদিন স্কুল, টিচার, পরদিন পরীক্ষার প্রস্তুতি সব মিলিয়ে কাহিল অবস্থা।
আর রাত জাগা উচিত নয়। কাল খুব ভোরে স্কুল আছে। আমি আমার মেয়েকে কাঁধে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলাম। ওর বয়স পনের চলছে। কিন্তু বাবার কাঁধে চরায় ওর দুনিয়ার আনন্দ।
বাতি নিভিয়ে দেয়া হলো।ডিম লাইটের দরকার নেই। মেঝে থেকে প্রায় ছাদ অব্দি লম্বা কাঁচের দরোজা ভেদ করে চাঁদের আলো পুরো ঘর হালকা আলোকিত করে রেখেছে। বাইরে অপূর্ব জোসনা।মাঝে মাঝে শেয়াল ডাকছে।তা থেমে গেলে আমাদের গভীর অরণ্যের মাঝখানে একলা বাড়িতে শুয়ে শুনা যাচ্ছে জঙ্গলের নিজস্ব ভাষা।
আমি আমার রাজকন্যার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললাম, মা গল্প শুনবি?
বলো বাবা, ঘুম আসছে না।
জানিস মা, তোর সালমান আংকেল জীবনে একটিই গল্প লিখেছিল। ক্লাশ নাইনে পড়ার সময়। সেই একটি গল্পই ওকে বিখ্যাত করে দিয়েছিল। তখনকার প্রধান পত্রিকা ‘ইত্তেফাকে’ ছাপা হয়েছিল।তারপর হই হই রই রই। কত লোক যে তাকে ওই পত্রিকার পাঠকের প্রতিক্রিয়া কলামে অভিনন্দন জানিয়েছিল! একটি মাত্র গল্প লিখে কেউ কখনো এতো আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারেনি।
গল্পটা কী বাবা?
সালমান লিখেছিল এক কিশোরের অভিমানের গল্প। এ অভিমানের সূত্র ধরেই সে ঈশ্বরের দেখা পেয়েছিল।
দূর বাবা, কী যে বলো! রাগ করলেই কি কেউ ঈশ্বরের দেখা পায়?
সালমান বলেছিল, পায়, মা, ঈশ্বরের দেখা পায়।
কীভাবে?
একটি ছেলে, বয়স মাত্র আট। ক্লাস থ্রিতে পড়ে। পরীক্ষায় খারাপ করায় একবার তার বাবা তাকে খুব বকলেন। বললেন, পড়ালেখা ছেড়ে রিকশা চালা, গাধা, তোকে দিয়ে পড়াশুনা হবে না।
শুধু বকলেন তা নয়, এরপর তাকে চড় থাপ্পড়ও দিলেন।
ছেলেটির খুব অভিমান হলো। সে ভাবলো, এ বাড়িতে তাকে কেউ পছন্দ করেনা। তাই সে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। আর কোন দিন ফিরবে না। কিন্তু কই যাবে? তার তো যাওয়ার মত কোন জায়গা নেই! হঠাৎ তার মনে হলো সে হাঁটতে হাঁটতে ঈশ্বরের কাছে চলে যাবে। সে শুনেছে তিনি অনেক দয়াবান। নিশ্চয় তিনি তাকে আশ্রয় দেবেন।
যেই কথা সেই কাজ।
পরদিন কেউ ঘুম থেকে উঠার আগেই সে স্কুলের ব্যাকপ্যাকে কয়েকটি কাপড়, কিছু বিস্কিট আর ফ্লাস্কে পানি নিয়ে ঈশ্বরের কাছে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়লো।
তারপর হাঁটতে লাগলো। হাঁটতে হাঁটতে পেরিয়ে এল অনেক দূর। আর কখনো সে বাড়ি ফিরবে না। ঈশ্বরের কাছে থেকে যাবে।
অনেক হেঁটে এক সময় তার খুব ক্লান্তি এলো।ক্ষিদেও পেয়েছে অনেক। তাই সে রাস্তার পাশে একটি গাছের নিচে বসে ব্যাকপ্যাক থেকে বিস্কিট আর পানি নিয়ে খেতে শুরু করলো। এমন সময় সে দেখলো একটু দূরে বসা অনেক বয়স্ক এক বুড়ি তার দিকে লোভাতুর চোখে তাকিয়ে আছে। ছেলেটি ভাবলো, আহা! বুড়ির নিশ্চয় ক্ষিদে পেয়েছে, তাই ওভাবে তাকাচ্ছে। সে উঠে গিয়ে বুড়ির কাছে গিয়ে বললো, দাদু, বিস্কিট খাবে?
বুড়ি ফোকলা দাঁতে হেসে ‘হ্যাঁ বললো।
ছেলেটি বুড়িকে কয়েকটি বিস্কিট দিলো।পানি খাওয়ালো। তারপর ঝিরানোর জন্য তার পাশেই বসে রইলো। এক সময় ক্লান্তিতে তার খুব ঘুম পেলো। সে বুড়ির কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লো।
ঘুম যখন ভাঙ্গলো, তখন দুপুর। ছেলেটির আবার খুব ক্ষিদে পেয়েছে। সে বুড়ির সাথে ভাগ করে আবার বিস্কিট খেলো। পানি খেলো।তারপর তার সাথে কুটুর কুটুর করে গল্প করতে লাগলো। বাবার সাথে রাগ করে যে সে বাড়ি ছেড়েছে তাও বলতে ভুললো না।
এই করতে করতে বিকেল হয়ে গেলো। বুড়ি মিষ্টি হেসে বললো, দাদু ভাই, বিকেল হয়েছে।এবার বাড়ি যাও। মা-বাবা নিশ্চয় অনেক মন খারাপ করছেন। চিন্তা করছেন।লক্ষ্মী ভাই, বাড়ি ফিরে যাও। বাবা তো তোমার ভালোর জন্যই বকেছেন।
ছেলেটিরও আসলে বাড়ির জন্য বুকের ভেতর মোচড় দিচ্ছিলো।সে শুধু কারো অনুরোধের অপেক্ষা করছিলো । তাই বুড়ি বলা মাত্রই সে বাড়ির দিকে রওনা দিলো। যাওয়ার সময় বুড়ি হঠাৎ হাত বাড়িয়ে তাকে বুকে টেনে নিয়ে লম্বা একটি চুমু খেল, তারপর বলল, সাবধানে যেও দাদু ভাই।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে তার রাত হয়ে গেলো। দরোজা খুলেই মা তাকে দেখে চিৎকার কর কাঁদতে কাঁদতে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।পেছনে দাঁড়িয়ে বাবাও চোখ মুছছেন। মা কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করলেন, বাবু, সোনা বাবু তুই সারাদিন কই ছিলি? বাবু, ও বাবু—- ???
ছেলেটিও মাকে জড়িয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করে উঠল, তারপর বললো, মামা, আমি ঈশ্বরের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তার সাথে দেখা হয়েছে। তিনি আমাকে চুমু খেয়েছেন। মা, ঈশ্বরের গায়ে কী সুন্দর গন্ধ—–!!
আর বুড়ি বাড়ি গিয়ে তাঁর মেয়েকে বললেন,মা,জানিস, আজ না ঈশ্বর আমাকে বিস্কিট খাইয়েছেন।আমি খুব ক্ষুধার্ত ছিলাম। তাই মনে মনে ঈশ্বরকে ডাকছিলাম।তাঁর কাছে খাবার চাইছিলাম।ওমা! একটু পর দেখি তিনি বিস্কিট নিয়ে হাজির!তাঁর বয়স খুব কম। একদম বাচ্চা ছেলে—–

গল্প শেষ করে আমি রোজাবেলের মাথায় হাত রেখে বললাম,মা জেগে আছিস?
হ্যাঁ, বাবা, সালমান আংকেল তো মারাত্মক লিখতেন।
হ্যা, মা।গল্পটাতে কী বলা হয়েছে বুঝেছিস মা?
হ্যাঁ, বাবা—আসলে মানুষের মধ্যেই ঈশ্বর বাস করেন, তাই না?
হ্যাঁ, মা।মানুষের মধ্যেই ঈশ্বর বাস করেন।তাকে খোঁজার জন্য বেশি দূর যাওয়ার দরকার নেই।
( এ সিরিজে যুগ যুগ ধরে চলে আসা দেশ বিদেশের গল্প কথার আশ্রয় নেয়া হবে।এগুলোর কোন নির্দিষ্ট স্রষ্টা নেই,মানুষের মুখে মুখে এসব গল্পের জন্ম হয়েছে। পরের পর্ব ৩০ নভেম্বর ,২০১৯ শনিবার বিকেলে।)