বাদল সৈয়দ - Badal Syed

রোজাবেল, মা, তোকে বলছি- ১৭

বাসায় অনেক মেহমান। খাবার টেবিলে রোজাবেল সবাইকে দেখভাল করছে।
আমার খুব ভাল লাগছে, কারণ আমার রাজকন্যা খুবই হাসিমুখে সবাইকে খাবার বেড়ে দিচ্ছে, শেষ হয়ে গেলে রান্নাঘরে
দৌঁড়ে গিয়ে আবার নিয়ে আসছে।
আহা! আমার কলিজা পাখি বড় হয়ে যাচ্ছে!
খাওয়ার পর অনেকক্ষণ সবার সাথে আড্ডা হলো। তারপর সবাই একে একে বিদায় নিলেন।
তখন সন্ধ্যা।
আমি আর রোজ বাগানে বসলাম। চারিদিকে হালকা বাতি জ্বলছে, মাঝে মাঝে সেগুলো রঙ বদলাচ্ছে। তাতে ফুটে থাকা অসংখ্য ফুলের রঙও পাল্টে যাচ্ছে। কখনো সাদা,কখনো হালকা বেগুনি, কখনো নীল, কখনো মৃদু কমলা রঙ।
বড় মনোহর সন্ধায়।
আমি আমার পরি মেয়েকে বললাম, মা, তুই যে আজ গেস্টদের এতো সুন্দর করে খাবার পরিবেশন করেছিস, তাতে আমি খুব খুশি।
‘থ্যাংকিউ বাবা’, রোজাবেল সলজ্জ হেসে বললো।
আমি বললাম, তবে মা সবচেয়ে ভালো লেগেছে, আসলে খাবার নয়, তুই তাঁদের উপহার দিয়েছিস আনন্দ। খাবার অনেকভাবেই পরিবেশন করা যায়, কিন্তু তার সাথে সব সময় আনন্দ আর মায়া মিশ্রিত থাকে না। এটা অনেক বড় ব্যাপার।
কেন বাবা?
তাহলে শোন, এ খাবার নিয়ে আমার একবার খুব তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল। বলতে বলতে টের পাই আমার কান গরম হয়ে উঠছে।
পুরোনো রাগ এখনো যায়নি।
রোজাবেল আমার হাত ধরে নরম গলায় বললো, বাবা কী হয়েছিল?
‘ মা, একবার একটি মিটিং এটেন্ড করার জন্য ভিয়েনা গিয়েছি। তোর মাসহ। আমি সারাদিন মিটিং এ ব্যস্ত থাকি, সন্ধ্যায় ওকে নিয়ে ঘুরতে বের হই।
একদিন মিটিং এর মাঝখানে কিছুক্ষণ বিরতি ছিল। আমি একা বের হলাম কফির দোকানের উদ্দেশ্যে। সামান্য হাঁটতেই একটি ছোট্ট নিরিবিলি ক্যাফে পাওয়া গেলো। এক তরুণী এটি চালাচ্ছে। খদ্দের বেশি নেই। আমার পাশে বুড়োমতো একজন বাউন্ডুলে টাইপ মানুষ। মজার ব্যাপার হলো এ ভরদুপুরে তিনি একটু পর পর বিয়ারের লম্বা গ্লাসে চুমুক দিচ্ছেন আর চেয়ারের পিঠে মাথা হেলিয়ে ঝিমুচ্ছেন। অন্যপাশে একটি কাপল কফি আর স্ন্যাকস নিয়ে বসেছেন। নিজেদের মধ্যে মশগুল।
আমি কফির অর্ডার দিলাম।
তা শেষ করে বিল চাইলাম। পাঁচ ইউরো বিল। আমি কিছু টিপসহ মেয়েটির হাতে বিল দিয়ে বেরিয়ে এলাম। কিছুটা হেঁটে আসতেই শুনলাম মেয়েটি পেছন থেকে ডাকছে। কিছুটা অবাক হয়ে আবার ক্যাফেতে ফিরে গেলাম। উৎসুক চোখে তাকাতেই মেয়েটি খুব রাগত স্বরে বললো, হেই মিস্টার, তুমি কফির বিল না দিয়ে চলে যাচ্ছো কেন?
আমার মাথায় তো আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা! এ বলে কী!
আমিও গলা ঝাঁঝিয়ে বললাম, তুমি এটা কী বলছো? আমি তো বিল দিয়েছি।
সে আরো উত্তেজিত কণ্ঠে বললো, না, দাওনি, তুমি মিথ্যে বলছো।
আমার রাগে শরীর কাঁপছে। কোন রকমে তা সামলে বললাম, তোমার ভুল হচ্ছে, আমি বিল দিয়েছি।
মেয়েটি এবার বললো, না, দাওনি, দিলে রিসিট দেখাও তো।
এবার আবার আকাশ ভেঙে পড়লো, আমি তো রিসিট সাথে নেইনি! যে চামড়া মোড়ানো ফোল্ডারে বিল দেয়া হয়েছিল তাতে রেখে দিয়েছিলাম।
এখন আমি কোন জবাব দিতে পারছি না। মেয়েটি ক্রুর হেসে বললো,এই তো প্রমাণ হয়ে গেলো তুমি বিল দাওনি, আমি পুলিশ ডাকছি—
অপমান এবং আতংকে আমার গলা শুকিয়ে গেছে। ভিয়েনার ঠান্ডা আবহাওয়ায় দরদর করে ঘামছি। এ বিপদ আমার পুরো ক্যারিয়ার ধ্বংস করে দেবে। এসব দেশে ‘শপ লিফটিং’ গুরুতর অপরাধ। এমন সময় পাশের টেবিলের বিয়ারে বুঁদ ভদ্রলোক ঝিম থেকে জেগে উঠলেন, তারপর ঠান্ডা গলায় মেয়েটিকে বললেন, ‘ও বিল দিয়েছে। আমি দেখেছি।’ তারপর আবার চেয়ারের পিঠে মাথা হেলিয়ে ঝিমুতে লাগলেন। সাথে সাথে পাশের টেবিলের কাপল একসাথে বলে উঠলেন, ও বিল দিয়েছে। আমরা দেখেছি। তুমি ভুল করে ওকে অন্যায়ভাবে দোষারোপ করছো।
মেয়েটি থমকে গেলো। তার চেহারায় নেমে এলো তীব্র অপরাধবোধ। সে মৃদু কন্ঠে বারবার বলতে লাগলো, সরি, সরি, আই আম সরি। আমার ভুল হয়েছে– বলতে বলতে সে আমার হাত জড়িয়ে ধরলো।
আমি নরম কণ্ঠে বললাম, ‘ইটস ওকে। তবে তোমাকে একটি কথা বলি, তুমি শুধু মানুষকে কফি সার্ভ করছো না, আনন্দও সার্ভ করছো। তাদের সে আনন্দটুকু দয়া করে নষ্ট করো না। কফির সাথে আনন্দ উপহার দিও,অপমান বা কষ্ট নয়।’
তারপর আমি আমার ‘জান পাখি’র মাথায় হাত রেখে বললাম, মা, মানুষকে প্রতিটি কাজে আনন্দ দেয়ার চেষ্টা করবি, কখনোই কষ্ট নয়।
রোজাবেল আমার হাত ধরে বসে আছে। গার্ডেন লাইটগুলো এখন ছড়াচ্ছে নীল রং, তাতে সবকিছু কেমন নীল নীল দেখাচ্ছে।
#আসুনমায়াছড়াই