অলস দুপুর।
আমরা বাপ-বেটি শুয়ে শুয়ে গান শুনছি। জাস্টিন টিম্বারলেইক গাইছেন।
“হোয়াট গোজ এরাউন্ড, কামস এরাউন্ড।”
তাঁর বান্ধবী কোনো কারণ ছাড়া তাঁকে ছেড়ে চলে গেছে। তিনি আহাজারি করছেন,”যে ব্যথা তুমি আমাকে দিয়েছো, তাই তোমার কাছে ফিরে আসবে।”
“হোয়াট গোজ এরাউন্ড, কামস এরাউন্ড।”
গানটা শেষ হলে আমি আমার মেয়েকে বললাম, মা,গানটা অতৃপ্ত প্রেমিকের হলেও, কথাটা খুব সত্যি।
“কোন কথা বাবা?”
“হোয়াট গোজ এরাউন্ড, কামস এরাউন্ড”- এ কথাটি মা।
আজ যা আমরা যা করছি, তা কিন্তু ভবিষ্যতে আমাদের দিকেই ফিরে আসবে। উই আর টু ফেইস আওয়ার ওউন ডিডস টুমোরো।”
“বাবা, একটু ক্লিয়ার করো প্লিজ।”
“তাহলে কয়েকটি ঘটনা শুন মা।”
১। বেশ ক’বছর আগের কথা। সিনিয়র একজন ব্যাংক অফিসারের রুমে গিয়েছি। কী একটা কাজ ছিল।
দেখলাম তিনি জুনিয়র একজন অফিসারকে ধমকাচ্ছেন। প্রায় বলার মত ভাষা না। তাঁর কথা হলো, সে অফিসার কাজে খুব স্লো। সেটাও সমস্যা না। সমস্যা হচ্ছে, সে সোফায় শুয়ে শুয়ে কাজ করে। বিশাল অভিযোগ।
অফিসারটি করুণভাবে বললেন, স্যার আমার ডিস্ক ইনজুরির সমস্যা। এটা হলে বেশিক্ষণ বসে থাকা যায় না। তীব্র ব্যথা হয়। তাই আমি আধ শোয়া হয়ে কাজ করি। তবে স্যার আমি কাজে ফাঁকি দেই না।
তরুণ অফিসার আমার পরিচিত। আমি তাঁর সমস্যার কথা জানি এবং এটাও জানি সে আসলেই কাজে ফাঁকে দেয় না।
কিন্তু সিনিয়র অফিসার তা কানে নিলেন না। তিনি
অসুস্থ মানুষটিকে বদলি করে দিলেন।
কয়েক বছর পর সে সিনিয়র অফিসারের সাথে তাঁর অফিসে দেখা। তিনি আরো উপরে উঠেছেন, কিন্তু কাজ করছেন অফিসে পাতা বিছানায় শুয়ে। সোফায় শুয়ে কাজ করাটাও তাঁর পক্ষে সম্ভব না। তাঁর দরকার বিছানা।
কারণ—- ডিস্ক ইনজুরি।
২। এটাও অনেক আগের কথা। পরিচিত এক বন্ধুর বাচ্চা হবে। হঠাৎ ইমারজেন্সি দেখা দিল। ভাবির অসময়ে পেইন উঠেছে। সে ছুটে গিয়ে তাঁর বসের কাছে কিছুক্ষণের জন্য একটি গাড়ি দেয়ার অনুরোধ করলো।
তিনি উত্তর দিলেন— বেবি টেক্সি আছে না?
সেদিন ভড়দুপুরে অনেক কষ্টে বন্ধুটি বেবি টেক্সি জোগাড় করে তাঁর স্ত্রীকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। তখন কিন্তু অফিসে কয়েকটি গাড়ি অলস পড়ে ছিল!
বেশ কিছুদিন পর সে ‘বস’ রিটায়ারমেন্টে গেলেন। আমার বন্ধুটি তখন একটি জেলার বড় কর্তা। ঘটনাক্রমে সেই বসের নিজের জেলা সেটি। তিনি প্রায়ই গ্রামের বাড়ি যেতেন আর করুণ কন্ঠে ফোন করে আমার বন্ধুর কাছে গাড়ি ধার চাইতেন।
বন্ধুটি ভাল মানুষ। অনুরোধ রাখতো!
৩। অনেক আগে কুমিল্লা বোর্ডে গেছি সার্টিফিকেট তোলার জন্য। সেগুলো নিয়ে ফটোকপি করলাম। কারণ পরদিন তা বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দিতে হবে।
এখন সেগুলোর সত্যায়ন দরকার। মনে পড়লো কুমিল্লায় পরিচিত একজন বড় অফিসার আছেন।
অনেক আশা নিয়ে তাঁর কাছে গেলাম। তিনি সত্যায়ন তো করলেনই না, বরং অনেকটা দূর দূর করে বের করে দিলেন।
এ ভদ্রলোক এখন প্রায়ই ফোন করেন। তাঁর ছেলেমেয়েদের সার্টিফিকেট সত্যায়ন করার অনুরোধ জানিয়ে।
৪. এক বন্ধুর ক্যান্সার। চিকিৎসার টাকা নেই। আমরা চাঁদা তুলছি। পাড়ার এক ধনী লোকের কাছে গেলাম।
তিনি তখন বিপুলভাবে খাওয়ায় ব্যস্ত। পাতে মাংস তুলতে তুলতে বললেন, ইফ ইউ হ্যাভ ক্যান্সার, ইউ হ্যাভ টু ডাইজেস্ট ইট— চিকিৎসার দরকার কী?
ভদ্রলোক এখন সব হারিয়ে নি:স্ব। তার উপর কামড় বসিয়েছে লিভার ক্যান্সার।
“নো আদার ওয়ে, রাদার ডাইজেস্টিং ক্যান্সার!!!”
রোজাবেল কাৎ হয়ে আমার কথা শুনছে। তার চোখে কৌতূহল নেচে বেড়াচ্ছে।
আমি হাত বাড়িয়ে আমার রাজকন্যার মাথায় হাত রেখে বললাম, মা,এখানে যে গল্পগুলো বলা হলো তা কারো উদ্দেশ্যে ঘৃণা প্রকাশের জন্য নয়। আমি চাই না কারো কপালে এগুলো ঘটুক। শত্রুর কপালেও নয়।
আমি শুধু তোকে এবং নিজেকে মনে করিয়ে দিচ্ছি- আজ আমি যা করবো, আগামীকাল তা-ই আমার কাছে ফিরে আসবে—-
হোয়াট গোজ এরাউন্ড, কামস এরাউন্ড।