বাদল সৈয়দ - Badal Syed

লক ডাউন এবং মা

কাল অফিস খুলে যাবে।
বন্ধকালীন পুরো দিনটা আমরা মা-ছেলে পাশাপাশি শুয়ে কাটিয়েছি। টুকটুক করে কত যে কথা হছে–
“ও বাবা,কী বই পড়?”
“মনমোহন সিং এর উপর লেখা আম্মা।”
“উনি কে জানি?”
” ইন্ডিয়ার প্রাইম মিনিস্টার ছিলেন।”
“ও, নাম শুনছি। উনি শিখ না? ভালো বইটা?”
“মোটামুটি আম্মা।”
“আমি হুমায়ূন সাহেবের বই পড়ি। মিসির আলির কাহিনী। ভালো লেখছেন।”
“পড়ো আম্মা।”
একটু পর, “ও বাবা, আমার মোবাইলে চার্জ আছে নাকি দেখো তো।”
“আছে তো, আম্মা।”
“কিন্তু ইন্টারনেট তো মনে হয় নাই।”
“আছে, আম্মা।”
“তাহলে ভাইবারে ফোন যায় না ক্যান?”
“আম্মা, এই তো যাচ্ছে।”
“ও, মনে হয় আমার আঙুলে জোর কমে গেছে। চাপ দিলে কাজ করে না।”
“করে আম্মা। তুমি হালকা চাপ দাও, জোরে দিলে সমস্যা হয়।”
“আচ্ছা, বাবা।”
“ও বাবা, একটু ঘুমাও না। চোখের ক্ষতি হবে তো।”
“আম্মা, এখন তো সকাল, দুপুরে ঘুমাই?”.
“আচ্ছা ঠিক আছে বাবা, দেখো তো চশমটা ময়লা কি না? ঝাপসা দেখি।”
“না, মা পরিষ্কার আছে, আচ্ছা,দাও মুছে দেই।”.
“বাবা, একটু চা খাও।”
“তুমি খাবা আম্মা?”
“না, বাবা, তুমি খাও, আমি তো বেটাইমে কিছু খাই না।”
“আচ্ছা, খাচ্ছি আম্মা।”
” দুইটা বিস্কুটও খাও। খিদা লাগছে না?”
“খাচ্ছি আম্মা।”
“বাবা, জোহরের আজান দিছে?”
“না,আম্মা, দেরি আছে।”
“আচ্ছা তাইলে আরেকটু পড়ি।”
কিছুক্ষণ চুপচাপ।
পাঁচ/সাত মিনিট দুজনে বই পড়লাম, তারপর আবার,
‘ও বাবা, লিজা, রোজ, ওরা কী করে?”
“ওরাও মনে হয় বই পড়ে আম্মা।”
“যাও না দেখে আসো, কিছু খাবে কি না?”
” আচ্ছা, যাচ্ছি আম্মা।”
ফিরে এসে বললাম, “আম্মা এবার একটু পড়ি?”
“আচ্ছা, আর ডিস্টার্ব করবো না,পড়।”
দুই মিনিট পর,
“ও, বাবা, ইতু, শাহিন,আজু ওরা কখন বাসায় আসতে পারবে?” ( আমার ভাইবোন)
“এই তো আম্মা আর কটা দিন। তুমি দোয়া করো।”
“আচ্ছা, পড়। আমি রেস্ট নেই।”
কিছুক্ষণ নীরবতা। মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছেন। না, ঘুমাননি,
“বাবারে।”
“জি, আম্মা।”
“তোমার সাথে যারা কাজ করে তাদের বইলো, আমি ওদের জন্যও দোয়া করতেছি।”
“বলবো আম্মা, একটু পড়ি?”
” পড় আব্বা, কী যেন পড়তেছিলা?”
‘ইন্ডিয়ান প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে নিয়ে।”
” ও আইচ্ছা। আমি হুমায়ূন সাহেবেরটা পড়ি। আগের মত জোরে পড়তে পারি না তো, আস্তে আস্তে পড়ি, তাই শেষ হয় না।”

কয়েক মিনিট আবার বই পড়লাম।
তারপর,
“ও, আব্বা, আমার মোবাইলে ব্যালেন্স কত আছে দেখবা?”
“২৮০০ টাকা আম্মা। অনেক ব্যালান্স আছে তো।”
“তোমরা সবাই ফ্লেক্সি করো তো তাই”- একটু লজ্জা পেলেন মনে হয়।
এভাবে দুপুর গড়ায়। আমরা খাওয়াদাওয়া সেরে রুমে আসি।
দেখি, বিছানায় বই নাই। আমি অবাক হয়ে বলি, বই গেলো কই?
আম্মা দুষ্টামির হাসি হাসেন, লুকাই রাখছি, এখন না ঘুমাবা বলছিলা।”
“আচ্ছা আম্মা,আমি ঘুমাই, তুমিও ঘুমাও।”
“আমার ঘুম আসে না। সবার জন্য প্রাণ জ্বলে। পুস্প,রাজু হাসু ওদের কতোদিন দেখি না! (এ তিন ভাইবোন বাইরে থাকেন।)
“এই তো আর কদিন আম্মা, সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি ঘুমাও।”
“ঠিক আছে আব্বা।”
চোখে তন্দ্রা। বুঝতে পারি তিনি ঘুমাননি। কাছে এসে মাথায় ফুঁ দিচ্ছেন।
ঘুম শেষে যখন জাগি, দেখি তিনি পাশে বসে আছেন।
“আম্মা, চা দিতে বলি?”
“আইচ্ছা বলো, খিদা লাগছে।”
“বলছি আম্মা।”
তারপর বিছানায় লেপ্টা মেরে বসে আমরা দুজন চা-বিস্কুট খাই।
“আব্বা, আরেকটা বিস্কুট খাও, কলা খাও। খিদা লাগবে তো।”
“খাচ্ছি আম্মা। তুমিও খাও।”
তিনি চায়ে বিস্কুট ভিজিয়ে খেতে খেতে আবার বলেন,
“আব্বা।”
“বলো আম্মা।”
“মোবাইলের চার্জ তো নাই।”
“দিচ্ছি আম্মা।”।
“কার মোবাইল ভালো, তোমার না আমার?”
“দুটোই এক। একই মডেল।”
“তাহলে আমার চার্জ কম থাকে কেন?”
“না,আম্মা, একই রকম থাকে। আমারও কিছুক্ষণ পরপর চার্জ দিতে হয়।”
” ও আচ্ছা, বাবা, আরেকটু ঘুমাবা?”
“এই মাত্র উঠলাম তো আম্মা। এখন একটু ফেইসবুকে কাজ করি? তুমি রেস্ট নাও।”
“আচ্ছা করো, আমি পড়ি। লাইটা জ্বালাও, চোখে কম দেখি।”
মাত্র একটা পোস্ট পড়া শুরু করেছি, এমন সময়,
“ও বাবা, আমার নখ তো লম্বা হইছে।”
“দাও আমি কেটে দেই।”
নক কাটা শেষে লজ্জিত হাসি,
“বাবা চুলে মেহেদি দিছি।”
“এজন্যই তো তোমাকে এত সুন্দর লাগছে আম্মা।” আমি তাঁর
চিবুক ধরে আদর করে দেই।
“আমার আব্বাও আমাকে ছোট বেলায় এইভাবে আদর করতেন।” বলতে বলতে তিনি মিষ্টি হাসেন।
তারপর সন্ধ্যা নামে, এখন আমি রোজ আর ওর মাকে সময় দেবো। কাল অফিস, সারাদিন মায়ের পাশে লেপ্টা মেরে শুয়ে থাকা যাবে না।
“আম্মা,যাই। একটু পর আবার আসবো।”
“আচ্ছা যাও, বাবা, কাল অফিসে যাইতে হবে?” “জী,আম্মা,যেতে হবে।”
“আমার ভয় করে আব্বা।”
আমি তাঁর বুকে মাথা লুকাই আর বলি ভয় নাই আম্মা,কিছু হবে না। তুমি দোয়া করছো না! দেখো না এর আগেও মাঝে মাঝে অফিসে গেছি, কিন্তু কিছু হয় নাই।”
“ফি আমানিল্লাহ বাবা। সবার জন্য ফি আমানিল্লাহ। “
এমন সময় আমার মায়ের শরীর থেকে তীব্র সুঘ্রাণ বের হয়ে আসে।
কেবল মায়েদের গা থেকেই এ সুঘ্রাণ বের হয়, আর কোথাও থেকে না।
(লেখাটি শেয়ার করা যাবে।)
#আসুনমায়াছড়াই