লিটল ফ্লাওয়ার

কুরিয়ার সার্ভিস থেকে ফোন এসেছে। তাদের কাছে নাকি আমার একটি ডকুমেন্ট এসেছে, তা অফিসে গিয়ে বুঝে নিতে হবে।
জিজ্ঞেস করলাম, ভাই, আমি কাউকে পাঠালে হবে?
উত্তর এলো, জি, স্যার, কাউকে পাঠান, আমরা আপনাকে ফোন করে কনফার্ম হয়ে ওনাকে দিয়ে দেবো।
প্যাকেটটি হাতে আসার পর খুলে একটু অবাক হলাম।এটি সে অর্থে ডকুমেন্ট নয়। পুরোদস্তুর চিঠি। এখনকার যুগেও যে কেউ চিঠি লিখে তা জানতাম না। কিন্তু যিনি লিখেছেন মনে হচ্ছে তিনি চিঠি লেখাতে অভ্যস্ত। খুব সুন্দর হাতের লেখা, ভাষাও গোছানো। তাতে লেখা-
‘সৈয়দ সাহেব।
আমার সালাম জানবেন। আপনি আমাকে চিনবেন না, আমিও আসলে আপনাকে সামনাসামনি কখনো দেখিনি। তবে আপনাদের কিছু সামাজিক কাজের সাথে আমার পরিচয় আছে। দীর্ঘদিন থেকে আমি সোসাল মিডিয়াতে সেগুলো ফলো করছি। পরে আপনার প্রকৃত পেশার পরিচয় পেয়ে পরিচিত একজন ইনকাম ট্যাক্স ল’ইয়ারের কাছ থেকে আপনার ফোন নাম্বার জোগাড় করে এ চিঠি পাঠালাম। তিনি আপনার পুরো ঠিকানা দিতে পারেননি। তবে তাতে সমস্যা হওয়ার কথা না, কারণ কুরিয়ার সার্ভিসগুলো ফোন নাম্বার ধরে যে-কোনো ডকুমেন্ট পাঠিয়ে দেয় বলে জানি।
যাই হোক, আসল কথায় আসি, কিছুদিন আগে দেখলাম আপনারা ঠিকানাহারা কন্যাশিশুদের জন্য একটি আশ্রম করতে চান। এটি আমার খুব ভালো লেগেছে। আপনি যদি কিছু মনে না করেন তবে একটি প্রস্তাব দিতে চাই। তাহলো জয়দেবপুরে আমার একটি বাংলো আছে। জায়গাটিও বেশ বড়। সব মিলিয়ে প্রায় এক একর হবে। এখানে একটি চমৎকার আশ্রম করা যায়। আপনারা সম্মতি দিলে আমি এটি বিনামূল্যে দান করতে চাই। যদি রাজি থাকেন, তবে ঢাকায় এসে আমার সাথে দেখা করলে খুব খুশি হবো। আমি খুব দুঃখিত, কারণ নিজে না গিয়ে আপনাকে আসতে বলছি। কিন্তু আমার বয়স হয়েছে আর্থ্ররাইটিসের কারণে হাঁটতে চলতেও বেশ কষ্ট হয়। যদি সম্ভব হয় আমাকে ফোন করে একটি টাইম ঠিক করে নিলে ভালো হয়। আপনাকে ফোন না করে চিঠি দিলাম, কারণ ফোনে সব সময় সিরিয়াসনেস বোঝানো যায় না। কিন্তু কষ্ট করে কেউ যখন চিঠি লিখেন, তবে ধরে নিতে পারেন তিনি সিরিয়াস।
সময় নিয়ে আমার চিঠি পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
বিনীতা
লিপিকা পাল।

চিঠিটি পড়ে কিছুটা ভ্রান্তির মধ্যে পড়ে গেলাম। এটা কীভাবে সম্ভব? চেনা নেই, জানা নেই, একজন ভদ্রমহিলা তাঁর এক একর জায়গাসহ বাড়ি দান করে দিতে চান! ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য। একবার ভাবলাম ইমোশোনালি অনেকেই অনেক কথা লিখেন, পরে ভুলে যান, এটাও সেরকম কিছু হবে হয়তো। তাই ভাবলাম ফোন করবো না। সত্যিই সিরিয়াস হলে তিনিই ফোন করে জানতে চাইবেন চিঠি পেয়েছি কি না?
আবার ভাবলাম, বয়স্ক একজন মহিলা চিঠি দিয়েছেন, হতে পারে তা আবেগের বশে লেখা, কিন্তু অন্তত একটি কার্টেসি কল তাঁকে করা উচিত।
ফোন করতেই ওপার থেকে রিনরিন কণ্ঠ ভেসে এলো, হ্যালো,কে বলছেন?

‘ আমার নাম বাদল সৈয়দ। আমি একটু লিপিকা পালের সাথে কথা বলতে চাইছি।’

‘লিপিকা বলছি’ আবার রিনরিন কণ্ঠ।‘

একটু অবাক হলাম। বয়স্ক একজন মহিলা, কিন্তু কণ্ঠ একদম কিশোরীর মতো! যেন কাচ ভেঙে টুংটাং শব্দে মাটিতে পড়ছে।

বিস্মিত ভাব গোপন রেখে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি আমাকে কোনো চিঠি দিয়েছেন?

‘হ্যাঁ দিয়েছি। সাড়া দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।’

আপনাকেও ধন্যবাদ। তবে আসলে আপনার চিঠি পড়ে আমি তেমন কিছু বুঝতে পারিনি।

‘কেন ওখানে তো লেখা আছে।’

তা আছে, কিন্তু ব্যাপারটা কেমন যেন না?

‘মানে।’

এই যে আপনি আমাদের বিশাল জায়গাসহ একটি বাড়ি দান করতে চাইছেন! ব্যাপারটা তো অবিশ্বাস্য। আপনি আমাকে চেনেন না জানেন না, হঠাৎ এ ধরনের প্রস্তাব—-

আবার কাচভাঙা হাসি ভেসে এলো, আমি আপনাকে চিনি না বলাটা ঠিক নয়। ফেইসবুকে অনেকদিন ধরে ফলো করি। কিন্তু তার উপরও নির্ভর করিনি, কারণ ওই জায়গায়টিতে বেশিরভাগ মানুষ এক ধরনের মুখোশ পরে থাকে। তাই পরিচিত বন্ধুবান্ধব, সাংবাদিক, বিশেষ করে ইনকাম ট্যাক্সে কাজ করেন এমন অনেকের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হয়েছি। আমার ধারণা পরিবারের পর একজন মানুষকে সবচে ভালভাবে জানে তার কাজের জায়গার লোকজন। তাই ট্যাক্সের লোকজনের দেয়া তথ্যের উপর নির্ভর করেছি সবচে বেশি। আপনি তো ওখানেই কাজ করেন তাই না?
‘জি।’
‘তাহলে বুঝতেই পারছেন ভালোভাবে খোঁজখবর নিয়েই আপনাকে প্রস্তাবটি দিয়েছি।’

আসলে আমি এখনো ক্লিয়ার না।

এবার তাঁর কন্ঠ বেশ সিরিয়াস শুনালো, ভাই, চিঠি পড়ে পুরো ব্যাপারটি ক্লিয়ার হবে না। আপনি কি সময় করে একবার আমার সাথে বসতে পারেন? কাজেকর্মে নিশ্চয় আপনার ঢাকা আসায় হয়।
আপনি কি ঢাকায় থাকেন?
‘না, জয়দেবপুর থাকি। যদি এখানে আসেন খুব খুশি হবো। ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করব। আমি কিন্তু সিরিয়াস। জয়দেবপর আসতে বেশি সময় লাগার কথা না, অবশ্য যদি ঢাকার বিখ্যাত ট্রাফিক জ্যামে না পড়েন। তারপরও আসুন। আমি একটু অসুস্থ, নয়তো নিজেই যেতাম।’

না, না, আমিই আসবো। তবে একটু সময় দিতে হবে। আগামী মাসে ঢাকায় আমার ঢাকায় একটি মিটিং আছে, তখন আসি?

‘আপনি এলে আমি খুব খুশি হবো।’

টেলিফোন রাখার পর মনে হলো, যাওয়ার কথা দিয়ে কী ভাল করলাম? এখন কতো ধরনের ফাঁদ পাতা হয়। তারপর ভাবলাম, আপাতত চুপ থাকবো। যদি উনি সাড়া না পেয়ে আবার যোগাযোগ করেন,তখন ভেবে দেখা যাবে।

এর মধ্যে কয়েকবার ঢাকা যাওয়া হলো, কিন্তু ভদ্রমহিলাকে নক করলাম না। মাস খানেক পর তাঁর ফোন এলো, কী ভাই, আপনি তো যোগাযোগ করলেন না। আমার প্রস্তাবটা মনে হয় সিরিয়াসলি নেননি।

আমি খুব লজ্জা পেলাম। এর মধ্যে যে ঢাকা গিয়েছি তা এড়িয়ে গিয়ে বললাম, দিদি, আমি খুব দুঃখিত। আগামী সপ্তাহে ঢাকা আসবো, তখন যোগাযোগ করবো।

এবার ব্যাপারটা নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবলাম। আমার স্ত্রীর সাথে আলাপ করলাম। ওকেও বিভ্রান্ত মনে হলো, বললো, একদম চেনো না, জানো না এরকম একজনের ডাকে অপরিচিত একটি জায়গায় যাবে? তোমার বন্ধু যেমন অনেক, শত্রুও তো কম নয়। কতো ধরনের হুমকি আসে। আমার মনে হয় না যাওয়া ভাল।

আমি বললাম, কিন্তু আমার কেন যেন মনে হচ্ছে,ভদ্রমহিলা বেশ সিরিয়াস। তাঁর কথা শোনা উচিত। তাছাড়া আলম তো সাথে থাকবে। ওতো খুবই রিলায়েবল।

আলম আমার গাড়ি চালায়। সাবেক সৈনিক। কমব্যাট সোলজার। ওর ওপর নির্ভর করা যায়।

শেষ পর্যন্ত আমার স্ত্রী রাজি হলো।

পরের সপ্তাহে ঢাকা গেলাম। কাজ শেষ করে লিপিকা পালকে ফোন করলাম। মনে হলো তিনি বেশ খুশি হয়েছেন। সাথে সাথে বিস্তারিত ঠিকানা দিলেন। জায়গাটি ঠিক জয়দেবপুর নয়। পুবাইলের কাছাকাছি।

কাজ শেষে রওনা দিতে দিতে বিকেল চারটা বেজে গেলো। তার উপর বিশাল ট্রাফিক জ্যাম। মনে হয় সারা শহরের গাড়ি এক জায়গায় বিশ্রাম নেয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। সব পার হয়ে টঙ্গী আসতেই প্রায় রাত আটটা বেজে গেলো। সেই সাথে শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি। এক হাত দূরের রাস্তাও দেখা যায় না। এদিকে ভদ্রমহিলা বারবার ফোন করছেন কদ্দুর এলাম। একবার মনে হলো বেশি রাত হয়ে গেলে তিনি বিব্রত হবেন। ব্যাপারটা বলতেই তিনি হেসে উড়িয়ে দিলেন। রিনরিন কণ্ঠে হেসে বললেন, আমার কোনো সমস্যা নেই, ভাবছি আপনাকে ঝামেলায় ফেলে দিলাম।

তাঁর বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় সাড়ে নটা বেজে গেলো। বুড়োমতো একজন মানুষ দরোজা খুলে বসতে দিলেন। বেশ সিম্পল রুমটা। তবে বেশ বড়। আরামদায়ক বেতের এক সেট সোফা, আরেকদিকে বেতের উঁচু পিঠওয়ালা দুটো চেয়ার, তার সামনে একটি কফি টেবিল। সেটার উপর একটি বাটিতে জলে ভাসছে কিছু নাম না জানা জংলি ফুল। তার পাশে সেদিনের পত্রিকা। ফ্যানের বাতাসে ফুলগুলো বাটির জলে দুলছে। মনে হয় দিঘিতে ভাসছে।
একটু পর তিনি এলেন। মধ্য ষাটের মতো বয়স হবে। তবে আর্থ্রাইটিসের কারণে সামান্য খোঁড়ালেও শরীর ধরে রেখেছেন। বোঝা যায় যৌবনে গল্প করার মতো সুন্দরী ছিলেন।
তাঁকে দেখে উঠে দাঁড়ালাম। তিনি হাতের ইঙ্গিতে বসতে বললেন, তারপর পাশের সোফায় নিজেই বসলেন।

‘ ভাই শেষ পর্যন্ত তাহলে আসলেন।‘

জি, সরি, আরো আগে আসতে পারিনি বলে।

‘এতে সরি বলার কিছু নেই। আপনার জায়গায় আমি হলেও হঠাৎ করে অপরিচিত কারো ডাকে হুট করে কোথাও যেতাম না।‘
আমি কিছু না বলে চুপচাপ বসে রইলাম।

তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আসুন, খেতে আসুন, তারপর আলাপ হবে।
কোনো ধরণের আলাপ টালাপ ছাড়া সরাসরি খাবার নিমন্ত্রণ! আমি অবাক হয়ে বললাম, না, না, আমি হোটেলে গিয়ে খাবো, আপনি বরং আলাপটি শেষ করে ফেলুন।

তিনি মৃদু হেসে বললেন, হোটেলে যেতে যেতে আপনার অনেক রাত হবে। আবহাওয়ার অবস্থা দেখেছেন? মনে হচ্ছে বৃষ্টি দুনিয়া উড়িয়ে নেবে। তাছাড়া সংকোচের কোনো কারণ নেই। আমি আপনার জন্য রান্না করেই রেখেছি। এমনিতেই না খাইয়ে ছাড়তাম না। কোনো ফরমালিটি ছাড়া খেতে বলছি, কারণ আপনার চোখে খিদে দেখতে পাচ্ছি। মেয়েরা এ ব্যাপারটা সবার আগে বুঝতে পারে। তাই লজ্জা না পেয়ে দয়া করে খেতে আসুন। অনেকক্ষণ ইলেক্ট্রিসিটি নেই, আমার ধারণা একটু পর আইপিএসও বন্ধ হয়ে যাবে। তখন খাওয়াটা ঝামেলা হবে। এসব বিবেচনায় আগেই খেয়ে নিতে বলছি। আসুন তো।
বলতে বলতে তিনি প্রায় শাসনের ভঙ্গিতে হাত ঝাপটা দিয়ে ভেতরের ঘরে রওনা দিলেন। অগত্যা কী আর করা, আমিও ইতস্তত পায়ে তাঁর পেছন পেছন গেলাম।

খাবার আয়োজনও কম নয়। খাসির ঝাল মাংস, কই মাছ ভাজা, পাঁচমিশালি সবজি আর সজনে দিয়ে ডাল, তাছাড়া সুন্দর করে একটি প্লেটে লেবু, কাঁচা মরিচ সাজানো।
খেতে বসে বললেন, রান্না খুব একটা ভালো হওয়ার কথা না, এ ব্যাপারটা আমি তেমন ভালো পারি না। নিয়মিত রান্না করা হয়ও না, নিয়ামত, মানে যে বয়স্ক লোকটি আপনাকে দরোজা খুলে দিলো ওই যা করে দেয় তাই খাই।
আমি সবজি মাখানো ভাত মুখে দিয়ে বললাম, খাবারের স্বাদ তা কিন্তু তা বলছে না।
তিনি রিনরিন করে হাসলেন।
এমন সময় চারিদিক আলো করে পরপর কয়েকটি বাজ চমকালো, জানালার শার্সি দিয়ে মনে হলো আকাশে রুপালি আগুন জ্বলছে। তিনি সেদিকে তাকিয়ে বললেন, অপূর্ব না?
আপনি বুঝি বৃষ্টি পছন্দ করেন? জিজ্ঞেস করলাম।
‘হ্যাঁ, বিশেষ করে আমার টিনের চালে যখন ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ে তখন অদ্ভুত ভালো লাগে। আপনার ভালো লাগে না?’
জি, বৃষ্টি আমারও খুব প্রিয়। তবে টিনের চালে তার শব্দ শোনার সৌভাগ্য আমার হয় না।
ঠিক এমন সময় আরেকটি বাজ পড়লো এবং সাথে সাথে আলো নিভে গেলো।
তিনি বিরক্তিসূচক শব্দ করে বললেন, এই যা, গেলো, বলেছিলাম না আইপিএস বেশিক্ষণ টিকবে না।
আমি আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বললাম, সমস্যা নেই, আমার খাওয়া শেষ।
বলতে বলতেই বয়স্ক লোকটি হারিকেন নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। লোকটার মধ্যে অদ্ভুত একটি ব্যাপার আছে। পায়ের শব্দ পাওয়া যায় না। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, নিয়ামত, ওনার ড্রাইভার খেয়েছেন?
‘জি,আম্মা।‘
ঠিক আছে তুমি বসার ঘরে হারিকেন দাও, তারপর দুকাপ চা নিয়ে এসো।
চায়ের কাপ হাতে নিয়ে তিনিই প্রথম বললেন, কী সিদ্ধান্ত নিলেন? আপনাদের আশ্রমের জন্য নেবেন আমার বাড়িটা?
আমি অবাক কণ্ঠে বললাম, কিন্তু কেন?
‘মানে?’
যদ্দুর বুঝছি এটি বেশ কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি, আপনি কেন এটা দেবেন?

হারিকেনের আলোয় দেখলাম,তাঁর মুখ কেমন বেঁকে গেছে, তাতে কেমন যেন অন্যরকম ছাপ।

তিনি কিছুক্ষণ জানালা দিয়ে বাইরের ঘন বর্ষার দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর বললেন, কারণ আমি জানি ঠিকানাহারা মেয়ে শিশুদের গন্তব্য শেষ পর্যন্ত কোথায় হয়। খুব ভালোভাবে জানি। তাই আমি চাই না একটি মেয়েকেও যাতে সে পরিণতি ভোগ করতে না হয়। আমার এ বাড়িতে হয়তো তাদের সবার আশ্রয় হবে না, কিন্তু যতোজনের হবে তারা তো বাঁচলো। তাদের কষ্ট আমার চে বেশি কেউ বুঝে না সৈয়দ সাহেব।
আমি বিস্ময় নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছি।

তিনি আবার হাসলেন, রিনরিন হাসি, কিন্তু সে হাসিতে তীব্র ঘৃণা। তারপর কিছুটা ঝুঁকে এসে বললেন, আপনি কি বুঝতে পারছেন যৌবনে আমার পেশা কী ছিলো?
আমি কোন কথা না বলে উপর নিচ মাথা দুলালাম। কেমন যেন খারাপ লাগছে। খুব খারাপ।

‘তবে সৈয়দ সাহেব আমি নিজের ইচ্ছায় এ পেশা বেছে নেইনি। আমার বাবা ছিলেন ময়মনসিংহের একজন হোমিওপ্যাথ ডাক্তার। খুব খারাপ পসার ছিলো না। আমাদের দুজনের ভালোই চলে যেতো। ও, হ্যাঁ, আপনাকে বলা হয়নি, আমার যখন আট বছর বয়স তখন আমার মা মারা যান। ধনুষ্টংকারে। তিয়াত্তুর সালে আমি আনন্দমোহন কলেজে পড়তাম। ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ার। তখন কোনো নোটিশ ছাড়া বাবা মারা যান। দিব্যি সুস্থ মানুষ। সকালে চেম্বার করেছেন। দুপুরে খেয়ে শুয়েছেন। বিকালে দেখি উঠছেন না। সন্ধ্যা গড়াতে নিজেই ডাকতে গেলাম। দেখি কোনো সাড়াশব্দ নেই। তখন আমি ভয় পেয়ে পাশের বাড়ির এক চাচাকে ডেকে আনি। তিনিও অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেলেন। তারপর তিনি এবং আরো কয়েকজন মিলে বাবাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে নিয়ে যান। সেখানে ডাক্তাররা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

বাইরে ঝড়ের তীব্র শোঁ শোঁ শব্দ ছাপিয়ে তাঁর দীর্ঘশ্বাস শোনা গেলো।
তিনি বলেই চলেছেন, সমস্যায় পড়লাম বাবা মারা যাওয়ার পর। তাঁর আয়ে আমাদের চলে যেতো। কিন্তু তিনি মারা যাওয়ার পর দেখা গেলো এক পয়সা সঞ্চয়ও নেই। থাকি ভাড়া বাড়িতে। কোনো জমিজমাও নেই। তেমন কোনো আত্মীয় স্বজনও নেই যার কাছে আশ্রয় নেবো। এ অকুলপাথার অবস্থায় এগিয়ে এলেন আমার এক দূরসম্পর্কের মেসোমশাই। তিনি ঢাকা থাকেন। গ্রামে এসে আমার অবস্থা শুনে বললেন, চাইলে আমি তাঁর বাসায় থাকতে পারি। তিনি আমাকে কলেজে ভর্তি করে দেবেন। তাঁর ভালো যোগাযোগ আছে, কোনো সমস্যা হবে না। তাছাড়া বাসায় তাঁর মেয়েরা আছে, আমি স্বচ্ছন্দে থাকতে পারবো। সবদিক চিন্তা করে আমি তাঁর সাথে ঢাকায় আসলাম।

টানা কথা বলে তিনি থামলেন, এক ঢোক পানি খেলেন। হালকা আলোয় দেখা যাচ্ছে তাঁর হাত কাঁপছে।
তিনি হাত বাড়িয়ে টিস্যু দিয়ে মুখ মুছলেন, তারপর বললেন, ঢাকায় আমরা একটি বাড়িতে উঠলাম এবং সেটি তাঁর বাড়ি নয়। আপনি কি আমাকে শুনছেন সৈয়দ সাহেব?
আমার আর শুনতে ইচ্ছে করছে না, তারপরও উপর নিচ মাথা দুলালাম।

‘ মেসোমশাই এর হাতেই আমার প্রথম সর্বনাশ হয়। তারপর তিনি আমাকে সেখানে ফেলে চলে যান। সেটি ছিল একটি হাই সোসাইটি গোল্ডেন কেইজ। শুনেছেন শব্দটা আগে?
এবার আমি দুপাশে মাথা নাড়ি, না, শুনিনি।
‘হাই সোসাইটি গোল্ডেন কেইজ হচ্ছে, সেখানে কথা শুনলে মেয়েদের রাজার হালে রাখা হবে। কথা না শুনলে চরম শাস্তি। একটি শাস্তির নমুনা দেই। আপনাকে ছাদে লাগানো লোহার আঙটার সাথে আড়াআড়ি বাঁধা হবে, একটি আঙটায় পা, অন্যটিতে হাত। তারপর মশাল জ্বালিয়ে আপনার চামড়ার নিচে ধরা হবে। এমনভাবে ধরা হবে যাতে গায়ে আগুন না লাগে, কিন্তু আপনার চামড়া জ্বলবে অমানুষিক যন্ত্রণা নিয়ে । অনেকটা বারবিকিউ করার মতো। তবে এখানে চামড়া যাতে ঝলসে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখা হবে। কারণ তা হলে আপনার দাম পাওয়া যাবে না। তবে যারা একেবারেই অবাধ্য ছিলো তাদের রোস্টই করা ফেলা হতো। তারপর বস্তায় বেঁধে দূরে কোথাও ফেলে আসা হতো।
আমি চুপ করে বসে আছি। কথা বলার শক্তি নেই।
এমন সময় বাইরে আবার বাজ চমকালো, তার আলোয় দেখা গেলো তাঁর চোখের কোণা চিকচিক করছে।
তিনি বলতে লাগলেন, প্রথম কয়েকদিন আমি অনেক বাধা দিয়েছিলাম। তারা না পেরে শেষ পর্যন্ত আরেকটি অবাধ্য মেয়েকে আগুনে আঁচ দেয়ার দৃশ্য আমাকে দেখতে বাধ্য করলো। সৈয়দ সাহেব, নিজের চোখে না দেখলে আপনি একজন মানুষের আগুনে কুঁকড়ে যাওয়ার দৃশ্য কল্পনাও করতে পারবেন না। সে চিৎকারও করতে পারছে না, কারণ তার মুখে কাপড় গুঁজে দেয়া হয়েছে। সে শুধু মোচড়ানোর চেষ্টা করছে,কিন্তু শক্ত করে বাঁধা থাকায় তাও পারছে না।
সে দৃশ্য দেখার পর আমার প্রতিরোধ আর টিকলো না। সোনার খাঁচায় বন্দি পাখিদের সাথে আমিও যোগ দিলাম। সে খাঁচায় শুধু প্রবেশ করতে পারতেন সমাজের খুব নামজাদা পয়সাওয়ালা পশুরা।

আমার মাথায় আগুন জ্বলছে, রাগ না অপরাধবোধের কারণে জানি না। আমি দুহাতের আঙুল এক করে মুঠো বেঁধে তাতে থুতনি ঠেকিয়ে বসে আছি। পুরো পৃথিবী যেন থেমে গেছে, বাইরে ঝড়ের শোঁ শোঁ শব্দও কানে আসছে না, শুধু পুরো ঘরময় ভেসে বেড়াচ্ছে তাঁর কাচের টুংটাং শব্দের মতো কণ্ঠ।

‘ এভাবে প্রায় এক বছর কাটলো। এ সময়টার বর্ণনা না দেয়াই ভালো। আপনি নিতে পারবেন না, সবাই সব কিছু নিতে পারে না। যাক গে, যা বলছিলাম, একদিন খবর এলো একজনকে আমার সেবা দিতে হবে। তবে তিনি এ সোনার খাঁচার পাখিদের কাছে আসবেন না। আমাকেই তাঁর কাছে যেতে হবে। আমার ‘মালিকদের’ দেখলাম খুব উত্তেজিত। কারণ নতুন পশুটি খুবই প্রভাবশালী এবং ধনবান । তাঁর কথায় বলা যায় শুধু ঢাকা শহর না পুরো দেশ উঠানামা করে। কিন্তু তিনি কখনো এদের সার্ভিস নেননি। তাই যেভাবেই হোক তাঁকে খুশি রাখতে হবে। তাহলে ভবিষ্যতে অনেক সুবিধা পাওয়া যাবে। আমাকে এ সার্ভিসের জন্য পছন্দ করার কারণ হচ্ছে আমার বয়স। অতি ক্ষমতাশালী পশুটি শর্ত দিয়েছেন যাকে পাঠানো হবে তার বয়স আঠারোর কোটায় হতে হবে। তার কমও না বেশিও না। আমার তখন আঠারো চলছে।

বলতে বলতে তিনি একটু থামলেন, তারপর বললেন, একদম বয়স ফিক্স করে দেয়ার ব্যাপারটায় অবাক হচ্ছেন? এ জগতে এটা মোটেও অবাক হওয়ার মতো কিছু নয়। পুরুষ মানুষের বাসনা যে আরো কতো অদ্ভুত হতে পারে তা ওই সোনার খাঁচার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে না গেলে আমিও বুঝতাম না।

বাইরে বৃষ্টির তোড় বেড়েছে। মনে হলো একটি গাছ ভেঙে পড়লো। তিনি সেদিকে মনোযোগ দিলেন না। বলতে লাগলেন, নির্ধারিত দিনে আমাকে নিতে গাড়ি এলো। বিশাল ঢাউস সাইজের গাড়ি। আমি ভয়ে কুঁকড়ে গিয়ে সেখানে উঠলাম। মালিকরা বলে দিয়েছে, ক্লায়েন্ট যা করতে বলবেন, তাই করতে হবে, নয়তো আগুনে ঝলসানো হবে। আমার খুব ভয় লাগছে, কী অভিজ্ঞতা হয়? আমি জানি এদের কতো ধরনের নিষ্ঠুর বিকৃতি থাকতে পারে। গাড়িতে আমার সাথে মালিকদের এক বডিগার্ড। যদি পালিয়ে যাই বা চিৎকার করি তাই।

বলতে বলতে তিনি থামলেন, আবার পানি খেলেন। এবার ঠোঁট মুছলেন আঁচল দিয়ে, মনে হয় পাশে রাখা টিস্যুর কথা খেয়াল নেই।

ঘণ্টাখানেক গাড়ি চালিয়ে আমাকে একটি বাড়িতে নিয়ে আসা হলো। গাড়ি থেকে দেখি বারান্দায় হারিকেন জ্বলছে। কিন্তু তা অমাবস্যার অন্ধকার পুরো দূর করতে পারেনি। বাড়ির বারান্দায় ঠিক মাঝামাঝি একটি সোফায় আবছামতো একজন মানুষ বসে আছেন। তাঁর চেহারা দেখা যাচ্ছে না, শুধু সাদা পাঞ্জাবি বারান্দার মাঝখানে জমাট বাঁধা অন্ধকারে ভেসে উঠছে।
আমি খুব ভয়ে ভয়ে গাড়ি থেকে নামলাম। কাছে গিয়েও তাঁর চেহারা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। তবে তিনি উঠে দাঁড়ানোর পর মনে হলো দীর্ঘদেহী একজন মানুষ, হাতে সিগারেট। আমার পেছনে মালিকের পাঠানো বডিগার্ড। তিনি আমার দিকে না তাকিয়ে তাকে শুধু বললেন, ‘আউট, কাজ শেষ হলে আমি খবর দেবো, এসে নিয়ে যেও।‘
বডিগার্ড একটি কথাও না বলে তড়িঘড়ি করে গাড়িতে উঠলো, তারপর তা সাঁ করে চলে গেলো।

আমি ভয়ে থরথর কেঁপে উঠলাম। এখন কী হবে? কী হবে?

তিনি ভরাট গলায় বললেন, এসো। আমি পায়ে পায়ে তাঁকে অনুসরণ করলাম। বিশাল একটি রুম। তাতে পুরোনো আমলের দোতলা খাট, মানে সিঁড়ি বেয়ে তাতে উঠতে হয়।
আমার ভয়ে দিশাহারা লাগছে। মনে হচ্ছে দৌড়ে পালিয়ে যাই। কিন্তু জানি তা সম্ভব নয়। গেইটে দারোয়ান আছে। তাছাড়া পালিয়ে যাবোই বা কোথায়? আমি জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। তিনি আবার ভারী গলায় হুকুম করলেন, খাটে উঠে বসো।
আমি কাঁপতে কাঁপতে খাটে উঠে বসলাম। তিনি সামনের চেয়ারে বসলেন। অনেকক্ষণ আমার দিকে চুপচাপ তাকিয়ে রইলেন, আমি তাঁর চোখের দিকে তাকাচ্ছি না। কারণ জানি সেদিকে তাকালেই দেখতে পাবো তীব্র লালসা।

অনেকক্ষণ কোনো সাড়াশব্দ নেই, তিনি একমনে সিগারেট টেনে চলছেন। একসময় সিগারেট শেষ করে তা মাটিতে ফেলে পা দিয়ে মাড়িয়ে দিয়ে নিজের মনেই বললেন, বাইশে জুলাই—-

এবার আমি অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকালাম। তিনি আবার বললেন, এ বছরের বাইশে জুলাই, প্রায় তিনমাস হলো। আমি কোনো কথা না বলে তাকিয়ে আছি। তিনি আবার সিগারেট ধরালেন, আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন, তারপর বললেন, বেঁচে থাকলে আজ আমার মেয়ের বয়স আঠারো হতো। কিন্তু বাইশে জুলাই সে মারা গেছে। কার এক্সিডেন্ট। আমি ওকে আদর করে ডাকতাম,’লিটল ফ্লাওয়ার।‘

আমি চমকে উঠে তাঁর দিকে তাকালাম। তিনি সিগারেট ফেলে কাছে এসে আমার পাশে বসলেন, তারপর বললেন, আমি তোমাকে এখানে এনেছি, কারণ আমি দেখতে চাই বেঁচে থাকলে সে কী ভঙ্গিতে ঘুমাতো? আঠারো বছর বয়সের মেয়েরা কীভাবে ঘুমায়, তারা কি ঘুমের মধ্যে মাঝে মাঝে হাসে? নাকি মা হারা বাচ্চারা ঘুম ভেঙে গেলে মাঝরাতে নিঃশব্দে কাঁদে?

এরপর আবার কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর নিজের মনেই গাইতে লাগলেন, ‘মাই লিটল ফ্লাওয়ার, ডান্সিং ইন দা উড’– গাওয়া থামিয়ে মৃদু হাসলেন, বললেন, এটি আমার বানানো গান। আমার মেয়ে রাগ করলে এটি গেয়ে শুনাতাম।
এরপর প্রায় টলতে টলতে তিনি খাটের কাছে এসে আমার ডানহাত নিজের হাতে নিয়ে বললেন, আমি শুধু তোমাকে এনেছি তোমার ঘুমের ভঙ্গি দেখার জন্য। আমার মেয়েটা কীভাবে ঘুমাতো, তুমি বলতে পারো? মাই লিটল ফ্লাওয়ার ,পুওর ডার্লিং ফ্লাওয়ার, ও কী ভঙ্গিমায় ঘুমাতো? ও কি ঘুমের মধ্যে হাসতো? না দেখা মাকে স্বপ্নে দেখে কাঁদতো?

তারপর মানুষটা হাউমাউ করে কান্না করে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আমি তোকে কোথাও যেতে দেবো না, তুই আমার সাথে থাকবি, শুধু আমি মাঝে মাঝে মাঝরাতে কোনো শব্দ না করে এসে দেখে যাবো তুই কীভাবে ঘুমাস—– মাই লিটল ফ্লাওয়ার।

বৃষ্টি কমে এসেছে। ভদ্রমহিলা হারিকেনের আলোয় আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এটাই সেই বাড়ি সৈয়দ সাহেব, আমার বাবার বাড়ি।

তিনি কাঁদছেন। হাসির মতো তিনি কাঁদলেও রিনরিন শব্দ হয়।

(গল্পটি শ্রদ্ধেয় সমরেশ মজুমদারকে উৎসর্গ করা হলো। তাঁর তাগাদার কারণেই এটির জন্ম হয়েছে। লেখাটি শেয়ার করা যাবে। সবাইকে ধন্যবাদ।)