সাধুসঙ্গ -৩২

২০১৬ সাল। ডিসেম্বর মাস।
তখন আমার সিলেটে পোস্টিং।
হঠাৎ আমেরিকা থেকে ডাক এলো। জাতিসংঘের ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কাউন্সিলের একটি সভায় যোগ দিতে হবে।
ভাবলাম এ উপলক্ষে নতুন একটি স্যুট বানাই। কিন্তু রওনা দিতে হবে চার দিনের মাথায়। এর মধ্যে একদিন যাবে ঢাকায়, সরকারি অনুমোদন নেওয়ার কাজে। বাকি তিন দিনের মধ্যে নতুন স্যুট হাতে আসতে হবে।
সিলেটে সমস্যায় পড়লেই প্রয়াত এডভোকেট সুপ্রিয় চক্রবর্তীর শরণাপন্ন হতাম। এক্ষেত্রেও তাই করলাম, বললাম, দাদা, দু/তিনদিনের মধ্যে ভালো একটা স্যুট বানিয়ে দিতে পারবে এমন কোনো টেইলরের সাথে পরিচয় আছে?
তিনি বললেন, এত অল্প সময়ের মধ্যে স্যুট বানানো খুব কঠিন হবে, তবে ‘রেমন্ড’ নামে যে টেইলরিং শপ আছে তাদের সাথে আমার বেশ খাতির আছে, চলুন সেখানে যাই, দেখি পারে কি না?
তখনই তাঁকে নিয়ে সে দোকানের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম; কিন্তু সেখানে গিয়ে বেশ হতাশ হলাম। তাঁরা জানালেন তাঁদের ‘স্যুট মাস্টার’ আসলে ঢাকায় থাকেন, সেখান থেকে অর্ডার করা স্যুট তৈরি হয়ে আসতে আসতে প্রায় এক সপ্তাহ লাগবে।
মন খারাপ করে ফিরে আসবো ঠিক তখন সুপ্রিয় দা বললেন, এক কাজ করবেন?
আমি বললাম,কী?
‘আমার পরিচিত একটি ছেলে আছে, ছোটো একটি টেলরিং শপে কাজ করে, আপনি চাইলে এখান থেকে কাপড় কিনে তাকে স্যুট বানানোর দায়িত্ব দিতে পারেন। ছোটো দোকান, কাজের চাপ নেই, কিন্তু আমার মনে হয় সে মন দিয়ে কাজ করবে।।আমার কাপড়চোপড় সে-ই বানায়। তবে স্যুট কেমন বানাবে জানি না, পরে আমার দোষ দিতে পারবেন না।
একবার ভাবলাম বাদ দেই, পুরোনোগুলো থেকে একটা দিয়ে কাজ চালিয়ে নেবো। কিন্তু কোন ভূতে পেলো কে জানে, তাই আগেপিছে না ভেবে বলে ফেললাম, ঠিক আছে চলুন, রিস্ক নিয়ে দেখা যাক।
সুপ্রিয় দা গলি তস্য গলি হয়ে যে ম্যাদামারা দোকানে আনলেন তা দেখে ঘাবড়ে গেলাম।
ভগ্নদশা দোকানের মরমর অবস্থা, ক্যাশ কাউন্টারে বয়স্ক মালিক বসে আছেন। একজন মাত্র তরুণ কর্মচারি। সে-ই টেইলরিং মাস্টার! একমাত্র দরজী!
বুঝলাম বিরাট বোকামি করেছি, স্যুটের কাপড়টাই মাটি হবে। একবার ভাবলাম ফিরে যাই; কিন্তু দাদা মন খারাপ করবেন বলে তা করলাম না। তার উপর দেখলাম তরুণ দরজী দাদাকে দেখা মাত্র সাষ্টাঙ্গে পায়ের ধুলো নিচ্ছে। এমন ভক্তিকে অপমান করা যায় না।
কী আর করা! বাধ্য হয়ে স্যুট বানাতে দিলাম। ছেলেটি অতি যত্নে মাপ নিলো, তারপর বললো, স্যার, কোনো চিন্তা করবেন না পরশু বিকেলের মধ্যে ডেলিভারি পেয়ে যাবেন।
তার কথায় ভরসা করার কোনো কারণ নেই, তাই মেজাজ খারাপ করেই বাড়ি ফিরে এলাম, তবে দাদাকে তা বুঝতে দিলাম না। বেচারা বড়ো আগ্রহ করে নিয়ে এসেছেন।
দুদিন পর বিকেলে দেখি সুপ্রিয় দা’র পেছন পেছন দরজীও হাজির। তার হাতে সদ্য বানানো স্যুটের প্যাকেট। সে এক গাল হেসে বললো, স্যার, একটু ট্রায়াল দিয়ে দেখেন, সমস্যা থাকলে ঠিক করতে হবে।
বড়োই তিক্ত মন নিয়ে জিনিসটা হাতে নিলাম, সেটা প্যাকেট বা স্যুট কাভারের বদলে পেপারে মোড়া হয়েছে। ভাবলাম এ ব্যাটা তো স্যুট কীভাবে ডেলিভারি দেওয়া হয় তা-ই জানে না, সে আর কী বস্তু উৎপাদন করবে?
কী আর করা! দাদাকে খুশি করার জন্য অফিসের উপরেই রেস্ট হাউজে গিয়ে ট্রায়াল দিলাম এবং চমকে উঠলাম। ছোকরা চমৎকার বানিয়েছে তো!
একদম ঠিকঠাক ফিট করেছে! এটা কীভাবে সম্ভব?
দ্রুত নিচে নেমে এসে বললাম, তুমি তো খুব ভালো বানিয়েছো। এটা কোথায় শিখলে? তার উপর এত অল্প সময়ে?
তরুণটি লাজুক হেসে বললো, নিজে নিজে শিখছি স্যার, লন্ডন যাওয়ার সময় যাদের হাতে বেশি টাকা থাকে না, তাঁরা আমার কাছে অর্ডার করেন, সেগুলো বানাতে বানাতে শিখে গেছি।
ব্যাপারটা অসম্ভব নয়, সিলেটিরা প্রায়ই লন্ডনে পাড়ি দেন৷ তারপরও আমার বিস্ময় কাটছে না, জিজ্ঞেস করলাম, তাই বলে এত কম সময়ে?
উত্তর এলো, গত দুই রাত প্রায় না ঘুমা স্যার। কাকার হুকুম, কাজটা শেষ করতে হবে না?
বলতে বলতে সে সুপ্রিয় দাকে ইঙ্গিত করলো।
তাকিয়ে দেখি যার কথা বলা হচ্ছে তিনি মিটিমিটি হাসছেন।
তরুণটিকে ধন্যবাদ দিয়ে পাওনা পরিশোধ করে বিদায় দিলাম৷ যাওয়ার সময় সে আবার চরম ভক্তি নিয়ে দাদার পায়ের ধুলো নিলো।
সে চলে যাওয়ার পর জিজ্ঞেস করলাম, দাদা, এ ছেলে আপনাকে এত ভক্তি করার কারণ কী?
‘তেমন কোনো কারণ নেই, তবে সে মদন মোহন কলেজে পড়ে। বেশ ভালো ছাত্র। ইচ্ছে আছে ইন্টারমিডিয়েট শেষ করলে ঢাকায় পড়তে পাঠাবো।’
মানে? আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
সামনে বসা অসম্ভব সুপুরুষ বৃদ্ধ মানুষটি বললেন, ওই দোকানে আমি অনেকদিন থেকে আমার কাপড় বানাই। বছর দুয়েক আগে একদিন গিয়ে দেখি, আগের মাস্টার নেই, তার জায়গায় এ ছেলে। কথায় কথায় জানলাম, সুনামগঞ্জ থেকে এসএসসি পাশ করেছে, গ্রামে বাবার ছোটো একটা দরজীর দোকান আছে, তা দিয়ে সংসার চলে না, তা-ই পড়াশুনা বাদ দিয়ে সিলেটের দোকানটিতে কাজ নিয়েছে- আগেই বাবাকে সাহায্য করতে গিয়ে কাজটি তার শেখা হয়ে গিয়েছিলো, তাই চাকুরি পেতে সমস্যা হয়নি।
তারপর? আমার বিস্ময় কমছে না।
সুপ্রিয় দা আবার স্মিত হেসে বললেন, সব শুনে বললাম, এই ছেলে, তোর তো মানুষের জন্য কাপড় সেলাই করতে করতেই জীবন যাবে, নিজে কোনোদিন ওই কাপড় পরতে পারবি না। এভাবে জীবন কাটাবি?
সে দেখি কোনো উত্তর দেয় না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তখন আমি বললাম, গজফিতার এ জীবন যদি বাদ দিতে চাস তাহলে চল আমার সাথে, কলেজে ভর্তি করে দেই। সে উত্তর দিলো, স্যার ইচ্ছা তো করে, কিন্তু খরচ কই পাবো? তারপর নিজেই জোর করে কলেজে ভর্তি করে দিলাম।
‘তার মানে আপনি তাকে পড়াচ্ছেন?’
‘ জি, কিন্তু পর্যাপ্ত টাকা দিতে পারি না, শুধু পড়ার খরচ দেই। বাকিটা সে ওই দোকানে পার্ট টাইম কাজ করে রোজগার করে।’
‘ এরকম কজনকে করেন দাদা?’
‘আছে কয়েকজন’, মনে হচ্ছে তিনি সংখ্যাটি এড়িয়ে যেতে চাইছেন।
‘কবছর ধরে করেন দাদা।’
‘করি আর কি।’
আমার কৌতূহল বাড়ছে, তাই জোর দিয়ে বললাম, অন্তত কতদিন থেকে করেন তা বলা যায় না দাদা?
তিনি খুব লজ্জিত ভঙ্গিতে বললেন, এই তো বছর চল্লিশ—–
মুহূর্তে তাঁর লজ্জা বিশাল হয়ে আমাকে গ্রাস করলো। ইচ্ছে হচ্ছে মাটির সাথে মিশে যাই, কারণ মাত্র মাস ছয়েক আগে বিপন্ন বাচ্চাদের শিক্ষায় সাহায্য করার জন্য ‘পে ইট ফরোয়ার্ড ‘ গঠন করে এ মানুষটির কাছে কত গর্ব করেছি! অথচ তিনি এ কাজ করছেন চল্লিশ বছর ধরে! কিন্তু একবারও তা বলেননি! আর মাত্র ছমাস কাজ করে অহমিকার বাতাসে আমার বুক ভর্তি হয়ে আছে!
আমি সামনে বসা বয়স্ক মানুষটির চোখের দিকে তাকাতে পারছি না।
লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে।

আসুনমায়াছড়াই।

(২০১৬ সালের জুন মাসে ‘পে ইট ফরোয়ার্ড’ জন্ম নেয়। ২০১৯ সালে সুপ্রিয় দা, যার ডাকনাম ছিল রঞ্জু, চির বিশ্রামে যান। তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। লেখাটি শেয়ার করা যাবে)