সাধু সঙ্গ

ঈদ আসলেই আমার তাঁর কথা মনে পড়ে।
দেখতে যেতে ইচ্ছে করে।
কিন্তু যাওয়া হয় না।
তিনি কোথায় ঘুমাচ্ছেন আমি তা জানি না।
ক্লাশ ফাইভে কীভাবে যেন বৃত্তি পেয়ে গেলাম!
ঈদের আগে আগে।
খুশিতে বাগবাগ বাবা বললেন ‘ তোকে একটা ভাল কিছু দেবো, কী নিবি?’
আমার চোখে ঝলমল করে উঠলো সেই দোকানটা।
জুতোর দোকান।
শহরে নতুন খুলেছে, রিকশা দিয়ে যাওয়ার সময় এক ঝলক দেখা যায়।
নানা রঙের জুতো।
কিনতে খুব ইচ্ছে হয় কিন্তু বলার সাহস হয় না।
মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুদের সব ইচ্ছে পূরণ হয় না।
তবু সেদিন সাহস করে বলে ফেললাম।
পুত্রের কৃতিত্বে মুগ্ধ বাবা এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন।
পরদিন দোকানে গিয়ে আনন্দে আমার ডানা গজিয়েছে।
কিন্তু মনে হলো বাবা একটু চিন্তিত।
জুতোর খুব দাম এবং এক দাম।
সম্ভবত তাঁর এতো টাকা বাজেট ছিল না।
তার উপর কঠিন ভাষায় নোটিশ ঝুলানো, ‘কোনক্রমেই বিক্রিত জুতা বদলানো বা ফেরত দেয়া যাবে না। ‘
ক্যাশ কাউন্টারে একজন বয়স্ক লোক বসে আছেন। তিনিই সম্ভবত দোকানের মালিক। খুব বদমেজাজি মনে হচ্ছে।
খদ্দেরদের মোটেও পাত্তা দিচ্ছেন না।
‘কিনলে কিনেন, না কিনলে নাই’ অবস্থা।
মাঝে মাঝে কর্মচারিদের খাস চাঁটগাইয়া ভাষায় গালিগালাজও করছেন।
বাবা একটু ঘাবড়ে গেছেন।
তাঁর মানিব্যাগ সবসময় পাতলা।
সৎ মানুষের মানিব্যাগ কখনোই ভারি হয় না। হওয়া সম্ভব না।
ঈদের বাজার। আমি ছাড়া অন্য ভাই-বোনদের জন্যও কিনতে হবে। মা আছেন, দাদু – দাদি, আরো অনেকের জন্য কিনতে হবে।
অথচ আমার পছন্দের জুতোর দামই তিনশো টাকা!
সে আমলের জন্য অনেক দাম।
বাবা কিন্তু আমাকে কিছুই বুঝতে দিলেন না।
জুতোটি কিনে দিলেন।
আসার সময় পরোটা -মাংস খাওয়ালেন।
আমি নতুন জুতোর ডানায় ভেসে বাড়ি ফিরে আসলাম।
আর বাসায় জুতো পরে মহড়া দিতে গিয়েই ধপ করে মাটিতে পড়লাম।
উৎসাহের ডানা ছিড়ে গেছে।
দেখি জুতোটা সাইজে হচ্ছে না। খুব টাইট। হাঁটা যায় না।
দোকানেও তাই মনে হচ্ছিলো। কিন্তু এই জুতো আর নেই বলে বলিনি। ভেবেছিলাম কষ্ট করে পরে ফেলবো।
কিন্তু বোঝা যাচ্ছে সেটা সম্ভব না।
বাবাকে বলতে খুব ভয় হচ্ছে। তারপরও ভয়ে ভয়ে বললাম।
তাঁর মুখ থমথমে হয়ে উঠলো। সম্ভবত সামনে ভেসে উঠেছে, দোকানির কঠিন মুখ, কর্মচারিদের উদ্দেশ্যে তাঁর গালাগালি, আর ভয়ংকর সেই নোটিশ যেখানে লেখা আছে, ‘কোনক্রমেই বিক্রিত জুতা বদলানো বা ফেরত দেয়া যাবে না। ‘
এতো শখের জুতো!
এতো দামের জুতো!
ভয়ে ভয়ে বললাম, আব্বা বশর ভাইকে নিয়ে দোকানে যাই? বলে দেখি, বদলে দেয় কীনা?
তিনি কিছু বললেন না।
গম্ভীর মুখে ঘুমাতে গেলেন।
আমার কান্না পায়, ঘুম আসে না।
আহা! দোকানদাররা কেন একটু ভালো হয় না?
বিক্রি করা জিনিষ বদলে দেয়ার মত ভালো।
পরদিন অফিস শেষে বাবা বললেন, চল, যাই, দেখি চেষ্টা করে।
দোকানে গিয়ে সেই কঠোর চেহারার মালিককে দেখে ভয় লাগে।
কুন্ঠিতভাবেই বাবা তাঁকে সমস্যার কথা বললেন।
বাবার করুণ চেহারা দেখতে আমার খুব খারাপ লাগে।
সব বাবারাই বাচ্চার কাছে হিরো।
এই বীর পুরুষকে অসহায় চেহারা তাদের ভাল লাগে না।
আমারও না।
মনে হচ্ছে, গোল্লায় যাক জুতো।
এক ছুটে বের হয়ে বাড়ি ফিরে যাই।
বাবার কথা শেষ হতেই দোকানি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন।
ইশারা করলেন,’বিক্রিত মাল ফেরত হয় না’ লেখাটার দিকে।
তারপর ফোঁসফোঁস করে একজন কর্মচারিকে যা বললেন তাতে প্রথমে মনে হবে তিনি রেগেমেগে অশ্রাব্য চিৎকার করছেন।
কিন্তু দুরুহ চাঁটগাইয়া ভাষায় বলা কথাগুলোর সরল বংগানুবাদ করলে যা দাঁড়ায় তার অর্থ হচ্ছে, এই বাচ্চাটা যে জুতো নিতে চায়, তাই নিতে দে। আর এক দৌড়ে গিয়ে বাখরখানি নিয়ে আয়।মিষ্টি বেশিটা আনবি। কম হলে জুতার পিটা।
তারপর বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন, ভাই সাহেব বসেন, আরাম করে চা খান, কোন চিন্তা নাই, বাচ্চার যা ভাল লাগে তাই নিবে।
বাবা অবাক হয়ে তাকাতেই বললেন, ফেরত না নেয়ার নিয়ম বাচ্চাদের জন্য নয়। ওরা হচ্ছে ফেরেশতা। আমার সাহস নাই ফেরেশতার মন ভাঙার। নবিজির নির্দেশ। আমি নাদান মানুষ, তাঁর আদেশ কীভাবে অমান্য করি?
আমার এক হাতে বদলে দেয়া নতুন জুতো,আরেক হাতে চটচটে বাখারখানি। খুব মিষ্টি।
বাবা চা খাচ্ছেন, তৃপ্তির সাথে।
সামনে বসা মানুষটি হাসছেন।
পবিত্র মানুষ!
#আসুনমায়াছড়াই