বাদল সৈয়দ - Badal Syed

রোজাবেল, মা, তোকে বলছি-১৪

আমরা বাপ-বেটি বাগানে বসে আছি।
ছুটির দিন।
অলস রোদ এসে পড়ছে পিঠের উপর।
রোজাবেল বই পড়ছে।
হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো, দাউদ, হোয়াটস দা বিহাইন্ড?
আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, মানে?
সে মৃদু হেসে বললো, তোর তাড়নাটি কী? সবাই কিন্তু জীবন সাজায় নিজস্ব একটি অনুভুতি থেকে। সবার আলাদা আলাদা তাড়না থাকে। ইন আদার ওয়ার্ড উই ক্যান সে ইট ইনার ফিলিং। তোর সেই ফিলিংটা কী?
এটা জানতে চাওয়ার কারণ?
কারণটি হলো, কোন ব্যাপারটি তোকে তাড়া করে, যা লাইফ মিশন তোর ঠিক করে তা জানতে চাওয়া। আই মাস্ট ডাইভ ইন টু দা ডিপ অফ মাই ড্যাড।
আমি মৃদু স্বরে বললাম, ভয়, মা?
ভয়! কিসের ভয়?
ছায়ার ভয় মা, আমি ছায়াকে খুব ভয় পাই।
মানে বুঝলাম না বাবা!
মা, আমি আর তোর খোকন চাচা একবার চেক রিপাবলিকের রাজধানী প্রাগের চার্লস ব্রিজ পার হচ্ছিলাম। এটি ঐতিহাসিক একটি ব্রিজ। সারা ব্রিজে যিশু, মা মেরি ও অন্যান্য সেইন্টদের স্ট্যাচু। এটি এতো ঐতিহ্যবাহী যে, শোনা যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এমন কী হিটলারও এটির উপর বোমা ফেলেননি। iআমরা যাচ্ছি ওপারে অবস্থিত কাফকা মিউজিয়াম দেখতে। পুরো ব্রিজে বিভিন্ন সাধু টাইপ মানুষ প্রার্থনার ভঙ্গিতে মাথা মাটিতে ঠেকিয়ে শুয়ে আছেন। কেউ কেউ তাঁদের মাথার পাশে রাখা পাত্রে পয়সা রেখে যাচ্ছেন। আমরা পাত্তা দিলাম না। শোনা যায় এদের বড় একটি অংশ ফেইক সাধু। পয়সা কামানোর ফন্দি। হঠাৎ চোখে পড়লো একজন সাধু শুয়ে নয়, বসে আছেন আর মৃদু স্বরে গান গাইছেন, I will sing of your love and justice; I will sing praise.
‘আমি গাইবো তোমার ভালবাসা আর বিচারের গান, গাইবো তোমারি প্রশংসা সকল।’
কারো দিকে তাঁর নজর নেই, পাশে ভিক্ষার পাত্রও নেই। তিনি আপন মনে পরিত্যক্ত একটি রাস্তার কুকুরকে আদর করছেন আর আপন মনে গাইছেন।
আমাদের কেন যেন মনে হলো, ইনি আসলেই সাধু টাইপ মানুষ। এর সাথে কথা বলা যায়।
দুজনে গিয়ে তাঁর পাশে বসলাম। বুড়ো মানুষটি চোখ বন্ধ করে গান গাইছেন। এক হাত কুকুরের শরীরে। আমাদের খেয়াল করলেন না। গান শেষে চোখ খুলে আমাদের দেখে পরিষ্কার ইংরেজিতে বললেন, বিদেশি তোমরা আমার কাছে কী চাও? সাহায্য করতে চাও? আমি তো ভিক্ষুক না।
আমরা লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি বললাম, না, না, আমরা আপনার সাথে পরিচিত হতে এসেছি।
তিনি উত্তর দিলেন, আমি অতি নগণ্য মানুষ। গল্প করার মতো না। তারপর বিড়বিড় করে একটা গান গাইতে লাগলেন, যার সাথে হাসন রাজার সেই বিখ্যাত গানের অবিকল মিল,
‘লোকে বলে
বলেরে ঘর-বাড়ি
ভালা না আমার।’
গান থামিয়ে বললেন, বিদেশি, যেখানে যাচ্ছিলে যাও। আমি একা থাকতে পছন্দ করি।
খোকন আমার হাত টেনে উঠে যাওয়ার ইঙ্গিত করলো। কিন্তু আমি অনেকটা নাছোড়বান্দার মতো জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি আমাকে কিছু বলতে পারেন, যা আমার কাজে লাগবে?
তিনি একমুখ দাঁড়িগোঁফের মধ্যে হাসলেন, বললেন, সন, আমার সে যোগ্যতা নেই। শুধু বলি,একজন মানুষ মারা যাওয়ার আগে তার চারপাশে অনেক ছায়া দেখতে পায়।সে তাদের জিজ্ঞেস করে, তোমরা কারা?
এক ছায়া উত্তর দেয়, আমি তোমার হৃদয়। আমি চেয়েছিলাম ভালবাসায় পূর্ণ হতে। তুমি তা হতে দাওনি, বরং আমাকে পূর্ণ করেছো লোভ এবং হিংসায়।
আরেক ছায়া উত্তর দেবে, আমি তোমার চোখ। আমি চেয়েছিলাম মমতা ধারণ করতে, সেখানে তুমি আশ্রয় দিয়েছিলে নিষ্ঠুরতা।
তার পাশে দাঁড়ানো ছায়া বলবে, আমি তোমার হাত, আমার খুব ইচ্ছে ছিল নিজেকে অন্যের জন্য ব্যবহার করবো, তুমি তা না করে শুধু নিজের জন্য ব্যবহার করেছ।
অন্য ছায়াটি বলবে, আমি তোমার মগজ, আমি চেয়েছিলাম মানুষের মঙ্গল চিন্তায় নিজেকে নিবেদন করবো, কিন্তু তুমি আমাকে ব্যবহার করেছ কেবল নিজের স্বার্থে।
একটু দূরে দাঁড়ানো অপর ছায়া ঝুঁকে এসে বলবে, আমি তোমার ঠোঁট। আমি চেয়েছিলাম সব সময় মিষ্টি হাসি, তুমি হাসোনি। অথচ একটু হাসি কত মানুষকে আনন্দ দিতো, তাই না?
বলতে বলতে তিনি হাত নেড়ে আমাদের ডিসমিস করে দিয়ে বললেন, সন, এ ছায়াগুলোর জন্য উত্তর ঠিক করে রাখো। তারপর আবার গুনগুন করে গান গাইতে লাগলেন, I will sing of your love—
রোজাবেল মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনছে।
আমি আমার রাজকন্যার মাথায় হাত রেখে বললাম, মা, আমার এই ছায়াগুলোকে খুব ভয়। তাদের অভিযোগের ঠিক জবাব দিতে পারবো তো?
গাছের ফাঁকে রোদ এসে পড়ছে আমার হাতে, তা গড়িয়ে নেমে যাচ্ছে আমার মেয়ের মাথায়।
#আসুনমায়াছড়াই