অসহায়দের বন্ধু ওরা – সমকাল

পেশায় প্রকৌশলী সাইফুল আলম নেসার চাকরি করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। চাকরির পর বাকি সময় কাটান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে অসহায় ও অজ্ঞাতনামা রোগীদের সেবা করে। যার কেউ নেই তার পাশে দাঁড়ান নেসার, অজ্ঞাতনামা রোগীদের সুস্থ করে বাড়ি পৌঁছে দেন। ২০০৭ সাল থেকে গত ১৪ বছরে ৮৫০ জন অসহায় রোগীকে সেবা দিয়ে সুস্থ করে তুলেছেন তিনি। তাই নেসার হয়ে উঠেছেন ‘অসহায় রোগীর বন্ধু’।

করোনাকালে বদলে যায় নেসারের সেবার যুদ্ধ। বাড়িতে বাড়িতে করোনায় আক্রান্ত মুমূর্ষু রোগীরা যখন মারা যাচ্ছিলেন অক্সিজেনের অভাবে তখন তিনি তাদের সেবায় অনুকরণীয় এক দৃষ্টান্ত তৈরি করলেন। গত ৪ জুন মাত্র একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে শ্বাসকষ্টের রোগীদের সেবা দেওয়া শুরু করেন নেসার। তার এই উদ্যোগে দ্রুত শামিল হয় মানবিক মানুষদের সংগঠন পে ইট ফরোয়ার্ড, অনেস্ট ও মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন। ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দেয় আলহাজ শামসুল আলম ফাউন্ডেশন ও কানেক্ট দি ডটস। ঢাকা ও চট্টগ্রামের ২৫টি রোটারি ক্লাব শতাধিক অক্সিজেন সিলিন্ডার দেয়। দ্রুততম সময়ে গড়ে ওঠে অক্সিজেন ব্যাংক। বর্তমানে (১ জুলাই পর্যন্ত) এই অক্সিজেন ব্যাংকে রয়েছে ৪০০ অক্সিজেন সিলিন্ডার। শহর-গ্রামের কোথাও কারও শ্বাসকষ্ট হচ্ছে- ফোনে এমন খবর পেলেই স্বেচ্ছাসেবীরা অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে ছুটছেন রোগীর বাড়ি। ইতোমধ্যে অক্সিজেন সেবা কার্যক্রম চট্টগ্রাম ছাড়িয়ে সম্প্রসারিত হয়েছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, রাজশাহী ও খুলনায়। গত ২৭ দিনে সারাদেশে ১৬০০ রোগীকে অক্সিজেন সেবা দেওয়া হয়েছে।

করোনাকালে ডাক্তার-নার্সদের বিনামূল্যে পিপিই প্রদান, মুমূর্ষু রোগীদের অক্সিজেন ও টেলিমেডিসিন সেবা প্রদান এবং নগদ অর্থ সহায়তাসহ বহুমুখী উদ্যোগ নিয়ে মানবসেবার অনুপম উদাহরণ তৈরি করেছে চট্টগ্রামের ছয় সামাজিক সংগঠন পে ইট ফরোয়ার্ড, অনেস্ট, নেসার ফাউন্ডেশন ও মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, আলহাজ শামসুল আলম ফাউন্ডেশন ও কানেক্ট দি ডটস। তবে মানবিক এই কর্মযজ্ঞের নেতত্বে রয়েছে পে ইট ফরোয়ার্ড। দেশসেবায় অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত রাখা এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা হলেন চট্টগ্রামের কর কমিশনার ও কথাসাহিত্যিক বাদল সৈয়দ। ‘আসুন মায়া ছড়াই’ এই স্লোগান নিয়ে তিনি করোনাকালে বহুমুখী সেবা কার্যক্রমে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

সংশ্নিষ্টরা জানান, অক্সিজেন ব্যাংকের সঙ্গে পরে যুক্ত হয় আলহাজ শামসুল আলম ফাউন্ডেশন ও কানেক্ট দি ডটস। রোটারি ক্লাব অব আগ্রাবাদ একাই দিয়েছে ৫০টি অক্সিজেন সিলিন্ডার, কানেক্ট দি ডটসের প্রতিষ্ঠাতা তানভীর শাহরিয়ার রিমন দিয়েছেন ৩০টি। নাম না জানা কত মানুষ, কেউ একটি, কেউ দুটি, আবার কেউ ১০-১৫টি সিলিন্ডার কেনার জন্য টাকা পাঠিয়েছেন।

এদিকে, পে ইট ফরোয়ার্ড, অনেস্ট, মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন করোনাকালে গত তিন মাসে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে প্রায় চার কোটি টাকা মূল্যের ৪০ হাজার লেভেল-১, লেভেল-২ ও লেভেল-৩ পিপিই বিতরণ করেছে। পে ইট ফরোয়ার্ড ও অনেস্ট গরিব-মেধাবী শিক্ষার্থীদের প্রতি মাসে ১৫ লাখ টাকা করে বছরে এক কোটি ৮০ লাখ টাকার শিক্ষাবৃত্তি দিচ্ছে। অসহায় মানুষদের দিয়েছে ৭০ লাখ টাকার নগদ সহায়তা। সে হিসাবে চলতি ২০২০ সালে মোট অর্থ সহায়তার পরিমাণ দাঁড়ায় আড়াই কোটি টাকা। অনেস্ট থেকে আর্থিক সহায়তা পাওয়া অনেক স্নাতকোত্তর পড়ূয়া বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সবজি বিক্রি করেও জীবিকা নির্বাহ করছেন। পে ইট ফরোয়ার্ডের উদ্যোগে চট্টগ্রামের ১৫ জনের একটি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল দিচ্ছেন টেলিমেডিসিন সেবা। এ পর্যন্ত এক হাজার মানুষকে টেলিমেডিসিন সেবা দেওয়া হয়েছে।

পে ইট ফরোয়ার্ডের প্রতিষ্ঠাতা, করোনাকালে মানবিক এই কর্মযজ্ঞের স্বপ্নদ্রষ্টা বাদল সৈয়দ বলেন, ‘সমাজের জন্য কিছু করা সবসময়ই আমাদের দায়িত্ব, আমরা তা পালন করছি মাত্র। অনেস্ট ও পে ইট ফরোয়ার্ডের ৬০ হাজার সদস্য এই মানবিক কাজের খরচ চালাচ্ছেন। সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে প্রায় ৩৫ জন কর্মী সারাদেশে ২৪ ঘণ্টা কাজ করছেন।’

সরকারের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও পে ইট ফরোয়ার্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওয়াহিদ হোসেন পিপিই তৈরি ও বিতরণ প্রসঙ্গে বলেন, ‘৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। সরকারি অনুমতি সাপেক্ষে ১৯ মার্চ থেকে লেভেল-১ পিপিই তৈরির কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়ি আমরা। আমদানির দিকে না গিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে অনুমতি নিয়ে দেশের পোশাক কারখানাতেই মানসম্পন্ন লেভেল-১ পিপিই তৈরির উদ্যোগ নিয়েছি আমরা। কারণ তখন সারা বিশ্বেই পিপিই ও মাস্ক সংকট ছিল।’ তিনি আরও বলেন, ‘একটি লেভেল-৩ পিপিইর জন্য ৮০টি নমুনা তৈরি করা হয়। সেখান থেকে সবচেয়ে কার্যকর একটি নমুনা বেছে নেওয়া হয়েছে। আমরা শুরু থেকে ডাক্তারদের সুরক্ষা নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন ছিলাম। কারণ তারা আক্রান্ত হলে মানুষকে কে সেবা দেবে? এই চিন্তা থেকেই করোনাকালের শুরুতেই পিপিই তৈরির এই উদ্যোগ।’

অক্সিজেন ব্যাংকের প্রথম উদ্যোক্তা সাইফুল ইসলাম নেসার বলেন, ‘জুন মাসের শুরুতে যখন মুমূর্ষু রোগীরা অক্সিজেনের অভাবে কষ্ট পাচ্ছিলেন তখন এক বড় ভাইয়ের সহায়তায় একটিমাত্র অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে সেবা কার্যক্রম শুরু করেছিলাম। ভেবেছিলাম, এত বড় চট্টগ্রাম শহর, নিশ্চয় অনেকে এগিয়ে আসবে। আমার আশা পূরণ হয়েছে। আসলে মানুষের জন্য কিছু করতে পারলে, মানুষের বিপদে পাশে থাকতে পারলে নিজেকে বেশ সুখী মনে হয়।’

মাদারবাড়ী এলাকার মোহাম্মদ শরীফ বলেন, ‘কিছুদিন আগে রাত ৩টায় আমার হঠাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। তখন চোখে যেন অন্ধকার দেখছিলাম। ফেসবুকে অক্সিজেন ব্যাংকের কার্যক্রম সম্পর্কে জেনেছিলাম। দ্রুত সেখানে ফোন করি। তাদের কর্মী আবির সেন রাজু এসে আমাকে অক্সিজেন দিয়ে যান। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্টে অক্সিজেন পেয়ে মনে হলো আল্লাহ যেন ফেরেস্তা পাঠিয়েছে।’

পে ইট ফরোয়ার্ডের টেলিমেডিসিন সেবায় যুক্ত ডা. ভাগ্যধন বড়ূয়া বলেন, ‘পরামর্শের জন্য খুলনা, লালমনিরহাট থেকেও রোগীরা ফোন করেন। আমরা ডাক্তাররা যখন রোগীদের সঙ্গে আন্তরিকতা নিয়ে কথা বলি, পরামর্শ দিই, তখন তারা খুব খুশি হয়। এই দুঃসময়ে আমরাও সেবা দিতে পেরে আনন্দিত।’