একান্ত সাক্ষাতকারে বাদল সৈয়দ: আমরা বিদেশী সাহায্য নেবো না। আমরা দেখাতে চাই, বাংলাদেশিরাও টাকার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে পারে: বাদল সৈয়দ

কবি, লেখক, সাহিত্যিক ও সমাজ সেবক বাদল সৈয়দ পেশাগত জীবনে সরকারি কর্মকর্তা। ১৯৯৪ সালে সিভিল সার্ভিসে (কর ক্যাডার) যোগ দিয়ে এখন চট্টগ্রামে কর কমিশনার পদে কর্মরত। ২০১৩ সাল থেকে জাতিসংঘের ট্যাক্স নিয়ে গঠিত প্যানেলে খণ্ডকালীন কাজ করছেন ।

তিনি চাকরির পাশাপাশি সমাজের উন্নয়নমূলক বিভিন্ন কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছেন। তাঁর মাথা থেকেই এসেছে পে ইট ফরোয়ার্ডের ধারণাটি। তাঁর নেতৃত্বে এর ২৪ হাজার মানুষ মানবসেবার ব্রত নিয়ে একটি মঞ্চে যেন এক হয়েছেন। ফেসবুকভিত্তিক সংগঠনটি ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের ধরে রাখে, তাদের পড়াশোনার খরচ জোগায় দাতাদের অনুদানে। এখন তাঁরা চারশ’র বেশি শিক্ষার্থীর পড়ালেখার খরচ জুগিয়ে যাচ্ছে। শুধু পড়ালেখা নয়, অনেক থমকে যাওয়া মানুষের জীবনকে এগিয়ে চলার পথ দেখাচ্ছে পে ইট ফরোয়ার্ড।

শুধু পে ইট ফরোয়ার্ড নয়, বাদলের সদা সক্রিয় সৃজনশীল মস্তিষ্ক থেকে উঠে এসেছে আরও কয়েকটি এ রকম অভূতপূর্ব সেবামূলক সংগঠন কিংবা প্রতিষ্ঠান। তার মধ্যে অন্যতম একটি হলো ‘অনেস্ট। এটিও ফেসবুকভিত্তিক ১৬ হাজার সদস্যের একটি সংগঠন।

মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম বাদল সৈয়দের। চাকরিজীবী বাবার ঘরে রেডিও বা টেলিভিশন ছিল না। ছিল শত শত বই। অফিস শেষে ঘরে ফিরে বাবা বইয়ে মগ্ন হয়ে যেতেন। গার্হস্থ্য কাজের ফাঁকে ফাঁকে মায়ের হাতে শোভা পেত নীহাররঞ্জন গুপ্ত বা ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের বই। বাবা-–মায়ের সূত্রে তিনি পাঠাভ্যাস তো পেয়েছেনই, তাতে বাড়তি যোগ হয়েছে লেখালেখি। তিনি শুধু বই পড়েন না, নিজে বই লেখেনও। কবি ও কথাসাহিত্যিক হিসেবে একটা পরিচিতিও গড়ে উঠেছে তাঁর। অনেক তরুণ-তাঁর আদর্শ অনুকরণ করার চেষ্টা করছে এবং তিনি তাদের কাছে দারুণ জনপ্রিয়। তাঁর বইয়ের পাঠকসংখ্যা অনেক।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সময় থেকেই লেখালেখির শুরু। কবিতা দিয়ে শুরু করলেও তাঁর প্রথম বই গদ্যের। তাঁর জন্মজয় ও জলের উৎস নামের দুটি গ্রন্থ পাঠক সমাদৃত হয়েছে। এ ছাড়া তাঁর অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে অলৌকিক আঙুল, সাধু সংঘ ও মাটির পিঞ্জিরার মাঝেসহ অন্যান্য জনপ্রিয় বই।

বাদল সৈয়দের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ে সাক্ষাতকার নিয়েছেন অনলাইন পত্রিকা newsarchives24.com এর সম্পাদক ও লেখক মো: দিদারুল আলম —

মো: দিদারুল আলম: আপনি সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করেন, এতগুলো সামাজিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত আছেন, কীভাবে সময় বের করেন?

বাদল সৈয়দ:  সময় আসলে কোন সমস্যা না। সমস্যা হচ্ছে এর সঠিক ব্যবহারে। আমি সময়ের কোয়ালিটি ব্যবহারে বিশ্বাসী। আমরা সব সময় বলি, এক ঘণ্টায় চার ঘণ্টার কাজ করতে হবে। তাই মজা করে বলি আমাদের দিন আসলে ২৪ ঘণ্টার নয়, ৯৬ ঘণ্টার। তাই সময় বের করা আমার জন্য কোন ব্যাপার না। সব করেও আমি সাত ঘণ্টা ঘুমাই।

মো: দিদারুল আলম: Pay It Forward Bangladesh  ও  Honest  মূলত কি ধরনের কাজ করে, কাদেরকে সহযোগিতা করা হয় এবং বাছাই প্রক্রিয়া কি?। বর্তমানে কতজন লোক উপকারভোগী হিসেবে আছেন?

বাদল সৈয়দ: পে ইট ফরোয়ার্ড মূলতঃ বিপন্ন শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করে। আমরা কোন টাকা পয়সা সরাসরি নেই না। আমাদের ফেইসবুক পেইজে বিপন্ন শিক্ষার্থী (ক্ষেত্র বিশেষে অন্যরাও) তাঁদের সমস্যার কথা জানান। তখন আমাদের ডোনাররা তাঁদের পছন্দ মতো সমস্যা বেছে নিয়ে সাহায্য করেন। যেহেতু আমাদের সদস্য ২৫ হাজারের মতো, এরা সবাই  কোন না কোনভাবে উপকৃত হচ্ছেন। কেউ দিয়ে আনন্দ পাচ্ছেন, কেউ নিয়ে উপকৃত হচ্ছে। তাছাড়া আমাদের সদস্যরা প্রতিদিন কোন না কোন ভাল কাজ করার ব্যপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কেউ রোগীর সেবা করছেন, কেউ ক্ষুধার্তকে খাওয়াচ্ছেন, কেউ আশ্রয়হ্নীকে বাড়িতে থাকার জায়গা দিচ্ছেন, বিনামূল্যে বাচ্চাদের পড়াচ্ছেন- এভাবে তাঁরা অসংখ্য মানুষের উপকার করে চলেছেন।

আর অনেস্ট আসলে চ্যারিটি পণ্য সরবরাহ প্রতিষ্ঠান। এখানে আমরা বাজার মূল্যের চাইতে কম দামে বা বিনামূল্যে প্রান্তিক পরিবারগুলোকে পণ্য দিয়ে থাকি। যে সামান্য লাভ হয় তার ৬০% আবার ক্রেতাদের তাৎক্ষণিক দিয়ে দেয়া হয়। মানে কেউ ১০০ টাকার পণ্য কিনলে সাথে সাথে ৬০ টাকা ফেরৎ পাচ্ছেন। বাকী ৪০% চলে যায় চ্যারেটিতে। অনেস্টের উদ্যোক্তারা এক টাকা লাভও নেন না, এমন কী বিনিয়োগও ফেরৎ নেন না। এটা তাঁদের পুরোটাই চ্যারেটি মিশন।

মো: দিদারুল আলম: প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি?

বাদল সৈয়দ: প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে আমার পরিকল্পনা হলো-

ক। পে ইট ফরোয়ার্ডকে এমন জায়গায় নিয়ে যাওয়া যাতে একজন ছাত্র-ছাত্রীও টাকার অভাবে পড়াশুনা থেকে বঞ্চিত না হয়।

খ। অনেস্টের লক্ষ্য হলো মধ্যবিত্তদের বাজারের বেনিয়া ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার খপ্পড় থেকে বের করে আনা।

মো: দিদারুল আলম: আপনার লেখায় পড়েছিলাম, আপনি সমরেশ মজুমদারের সাতকাহন পড়ে ট্যাক্স কমিশনারের পদটা পছন্দের প্রথমে রেখেছিলেন, কেন, আরো তো গুরুত্বপূর্ণ ক্যাডার ছিল?

বাদল সৈয়দ: হ্যাঁ, সমরশ মজুমদারের বই সাতকাহন পড়ে আমি কর ক্যাডারে এসেছি। আমার মনে হয়, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা যদি বলেন, তবে কর ক্যাডার অতি গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরাই সরকারের লাইফ লাইন। অন্যরা খরচ করেন, আমরা আয় করি। আজ আমরা যে মধ্য আয়ের দেশ, বা ভবিষ্যতে উন্নত দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখি, তা কিন্তু রাজস্ব ক্যাডারের হাত ধরেই হবে। আমাদের দেশকে ভিক্ষুকের অপবাদমুক্ত করেছে এ রাজস্ব ক্যাডারই। তাই এ ক্যাডারকে বলা হয় ‘সান রাইজ’ ক্যাডার। অবশ্যই অন্য ক্যাডারও গুরুত্বপূর্ণ, সবার অবদান অনস্বীকার্য, কিন্তু কর ক্যাডার হচ্ছে  দেশের অন্যতম চালিকা শক্তি এবং এর গুরুত্ব কখনো কমবে না। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাজেট ছিল মাত্র কয়েকশ কোটি টাকার, আর এখন তা চার লক্ষ পয়ষট্টি হাজার কোটি টাকা, যার প্রায়  তিন কোটি টাকা রাজস্ব ক্যাডারগুলো জোগান দেবে। অতএব বুঝতেই পারছেন, এ ক্যাডারগুলো কত গুরুত্বপূর্ণ এবং অনিবার্য। আমার তো মনে হয়, দেশের মূল চালিকা শক্তি এঁরাই।

মো: দিদারুল আলম: সমরেশ মজুমদারের এর সাথে এখনো কি যোগাযোগ আছে?

বাদল সৈয়দ: না, সমরেশ মজুমদারের সাথে তেমন যোগাযোগ নেই। তবে আগামী ০৭ ডিসেম্বর ২০১৮ বাতিঘরে তিনি আসছেন। আশা করি ওখানে দেখা হবে।

মো: দিদারুল আলম: সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আপনি Pay It Forward Bangladesh – র জন্য বিদেশীদের কাছ থেকে কোন ধরনের সহযোগিতা কামনা করেন নাই, এই ঘটনা বিরল এবং এর কারণ কি।

বাদল সৈয়দ: আমরা বিদেশীদের কাছ থেকে কখনোই সাহায্য নেবো না। সারাজীবন তারা ভেবে এসেছেন, বা আমরাই তাদের ভাবিয়েছি, বাংলাদেশ শুধু চাইতে জানে। আমরাই মানুষের বিপ্ননতা/অসহায়ত্ব বিক্রি করে তাঁদের কাছ থেকে টাকা এনেছি। আমরা মনে করি এ ধারণা বা ভিক্ষাবৃত্তির অবসান হওয়া দরকার। তাই আমরা কোন বিদেশী সাহায্য নেবো না। আমরা দেখাতে চাই, বাংলাদেশীরাও টাকার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে পারে।

মো: দিদারুল আলম: তরুণ সমাজের কাছে আপনি যথেষ্ট জনপ্রিয়। তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন। ভার্চুয়্যাল জগতের কারণে কি তারা বই পড়া থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

বাদল সৈয়দ: তরুণদের আমি ভাল মানুষ হতে বলি। সফল মানুষ নয়। আমাদের ভাল মানুষ দরকার, সফল মানুষ নয়। আর, হ্যাঁ, ভার্চুয়াল কারণে বই পড়া থেকে তারা কিছুটা বিমুখ হচ্ছে, তবে ভয়ের কিছু নেই। এটা কেটে যাবে। বই এর আকর্ষণ অবিনাশী।

মো: দিদারুল আলম: সাধুসঙ্গ আপনার বইগুলোর মধ্যে অন্যতম। মানুষের ভালো কাজগুলোর স্বীকৃতি নিয়ে অসাধারণ বইটি লিখেছেন।

বাদল সৈয়দ: আমাদের দেশে বিখ্যাত মানুষদের নিয়ে প্রায় সবাই লেখালেখি করে, হ্যাঁ এটা ঠিক আছে, তবে প্রতিনিয়ত আমাদের সমাজে প্রচারবিমুখ নতুন সাধুরা ভালো কাজ করে যাচ্ছেন। তাই তাঁদের নিয়ে সাধুসঙ্গ বইটি লেখা।

মো: দিদারুল আলম: নিজের কর্মকাণ্ড নিয়ে আত্মজীবনী লেখার পরিকল্পনা আছে কি?

বাদল সৈয়দ: আত্মজীবনী লেখার মতো কোন কাজ আমি করি নি।

মো: দিদারুল আলম: আগামী বই মেলায় আপনার কি কি বই প্রকাশিত হচ্ছে এবং কোন প্রকাশনি সংস্থা থেকে? বই বা বইগুলো নিয়ে কিছু বলেন।

বাদল সৈয়দ: আগামী বই মেলায় বাতিঘর একটি মোটিভেশনাল বই প্রকাশ করছে। আর অলৌকিক আঙুল আর জলের উৎসের নূতন সংস্করণ বের হতে পারে।

মো: দিদারুল আলম: সময় দেয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ

বাদল সৈয়দ: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ