পে ইট ফরোয়ার্ড আন্দোলন
লিলি হার্ডি হ্যামন্ডের ১৯১৬ সালে লেখা বই ‘ইন দ্য গার্ডেন অব ডিলাইট’-এ প্রথম পাওয়া যায় পে ইট ফরোয়ার্ড কথাটি। তবে এই ধারণাটি পুরনো। যার কাছে দায় তাকে নয়, বরং তৃতীয় অন্য কাউকে লাভবান করা এর উদ্দেশ্য। খ্রিস্টপূর্ব ৩১৭ অব্দেও ওই ধারণার ওপর নাট্যকার মেনানদার একটি নাটক লিখেছিলেন। ১৭৮৪ সালে বেনজামিন ওয়েবকে লেখা একটি চিঠিতে বেনজামিন ফ্রাংকলিন আবার ধারণাটি প্রকাশ করেন। পরে ১৯৯৯ সালে ক্যাথরিন রায়ান হাইড লিখেন ‘পে ইট ফরোয়ার্ড’ নামের একটি উপন্যাস। পরে হলিউডে এই নামে একটি চলচ্চিত্রও হয়। চলচ্চিত্রটি প্রশংসিতও হয়। ক্যাথরিন ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন দ্য পে ইট ফরোয়ার্ড ফাউন্ডেশন নামের একটি অলাভজনক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। ‘দয়া করো অচিন মানুষকেও, তাতে একটি মমতাঘেরা সমাজ গড়ে উঠবে’ প্রতিষ্ঠানটি এমন কথাই বলে। ২০০৭ সাল থেকে পে ইট ফরোয়ার্ড ডে-ও উদ্যাপন করা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী।
চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের সিজিএস কলোনিতে বাদলের জন্ম ১৯৬৮ সালে। তাঁরা সাত ভাই-বোন। বাবা মাঝারি মানের চাকরি করতেন। সেলাক ছিলেন। সংসার চালাতে হিমশিম খেতেন। বাদলদের বাসায় রেডিও বা টেলিভিশন ছিল না। তবে বই ছিল শত শত। মা-বাবার সূত্রেই বুঝি পড়ার অভ্যাসটা পেয়ে থাকবেন সৈয়দ বাদল।
মহিউদ্দিন খান
স্যারের নাম মহিউদ্দিন খান
আগ্রাবাদ সরকারি কলোনি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়তেন বাদল। এসএসসিতে কুমিল্লা বোর্ড থেকে মেধা তালিকায় পঞ্চম স্থান অর্জন করেন। বাদল এই সাফল্যের সবটুকু কৃত্বিত্ব দিতে চান শিক্ষক মহিউদ্দিন খানকে। স্যার তাঁকে প্রতিদিন ভোর ৪টায় উঠিয়ে পড়াশোনা করাতেন। হাঁটতে নিয়ে যেতেন। স্যার এর জন্য কোনো টাকা নিতেন না। পরে চট্টগ্রাম কলেজে যখন ভর্তি হলেন বাদল তখনো স্যার তাঁর সঙ্গী। এইচএসসিতেও মেধাতালিকায় নাম উঠেছিল বাদলের। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে লোক প্রশাসনে স্নাতক আর স্নাতকোত্তর হওয়ার সময়ও স্যার সঙ্গে থেকেছেন। তারপর একসময় বিসিএস পরীক্ষায় বসলেন বাদল। ফল পেতে বাকি। স্যার বরাবরের মতো একদিন ভোরে হাঁটতে নিয়ে গেলেন। বললেন, ‘তুই সারা বছর ফ্রিতে পড়াশোনা করেছিস। তুই যাঁদের টাকায় পড়েছিস, তাঁরা কারা জানিস? ওই দ্যাখ গার্মেন্টকর্মী, রিকশাওয়ালা। এঁরা তাঁদের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করাতে পারে না। এখন তোর ঋণ শোধের পালা। এখন তুই তাঁদের ঋণ শোধ করবি।’ বাদল একটি অন্য জগতের সন্ধান পেল। পেল একটি নতুন ভাবনা। উল্লেখ্য, বাদল সৈয়দ চট্টগ্রামে কর বিভাগের কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
যাত্রা শুরু
প্রথমে নাম রেখেছিলেন ‘পে ব্যাক সোসাইটি’। ১৯৯৬ সালের আগস্ট মাস। উদ্যোক্তা সৈয়দ মোহাম্মদ আবু দাউদ। বন্ধুরা ডাকে বাদল সৈয়দ নামে। বাদলের সঙ্গে তখন মোমিনুর রশীদ, খুরশীদ হোসেন বাপ্পী, হারুনুর রশীদ পিন্টু, শফিকুল ইসলাম, মোহাম্মদ ওয়াহিদ হোসেনসহ ৫০ থেকে ৬০ জনের একটি দল ছিল। তাঁদের কাজ ছিল পত্রিকা দেখে দেখে গরিব, মেধাবী, অসহায় শিক্ষার্থীদের খুঁজে বের করে যতটা সম্ভব আর্থিক সহায়তা দেওয়া। ২০ বছর পরে ২০১৬ সালে এটি বেশ বড় একটি প্ল্যাটফর্ম হয়ে ওঠে। আরো বেশি শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছানোর আগ্রহ বাদলের সব সময় ছিল। প্রবাসী বন্ধুরা এগিয়ে আসার পর ভাবনা সত্যি হতে সময় লাগে না। তাঁর এক প্রবাসী বন্ধু জানালেন, বিশ্বব্যাপী ‘পে ইট ফরওয়ার্ড’ নামে একটি আন্দোলন আছে। সে বন্ধুর পরামর্শেই তিনি নাম বদল করলেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পে ইট ফরোয়ার্ড বাংলাদেশ নামে গ্রুপ খোলেন। এ পর্যায়ে ইকবাল তানজির ও সায়মা আক্তার নামের দুই তরুণকে সঙ্গে পেলেন। ধীরে ধীরে তাঁদের কার্যক্রম বাড়তে থাকে, সদস্যসংখ্যাও বাড়তে থাকে। এখন গ্রুপের সদস্যসংখ্যা ২৫ হাজার।
পে ইট ফরোয়ার্ড বাংলাদেশ
এখানে শিক্ষার্থীরা বৃত্তির জন্য আবেদন করতে পারে। এটি যাচাই-বাছাইয়ের জন্য একটা নির্দিষ্ট কমিটি আছে। যাচাই-বাছাই শেষে কমিটি একটি ডোনার আহ্বান করে। তখন একজন ডোনার সেই শিক্ষার্থীর শিক্ষার পুরো দায়িত্ব নেন। এখানে ডোনারের নাম-পরিচয় গোপন রাখা হয়।
পে ইট ফরোয়ার্ড অর্থ আদান-প্রদানের সঙ্গে যুক্ত থাকে না। শিক্ষার্থীর কাছে সরাসরি ডোনার অর্থ দেন শিক্ষাবৃত্তি হিসেবে। এই ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা সঠিকভাবে বৃত্তি পাচ্ছে কি না, তাদের পড়াশোনা চালাতে আর কিছু প্রয়োজন কি না বা শিক্ষার্থী ঠিকঠাক পড়াশোনা করছে কি না এবং তাদের পরীক্ষার ফলাফল ভালো আসছে কি না—তার তদারকি করে পে ইট ফরোয়ার্ডের কমিটি।
এখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ৪০০ শিক্ষার্থী পে ইট ফরোয়ার্ডের মাধ্যমে শিক্ষাবৃত্তি পায়।
এক দিন কয়েকজন শিক্ষার্থী জড়ো হয়েছিলেন
কয়েকজন শিক্ষার্থী
লাকী আক্তার, আবু বকর, মাসুম মিয়া, তোইয়েবা বেগম, মানিক চন্দ্র দাস, জুবায়ের হোসেন বা দেবলীনা পাল এ রকম অনেক নাম।
২০০৮ সালে লাকী আক্তার এইচএসসি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। লাকীর বাবা বাসচালক। মেয়ের পড়াশোনার ব্যয় তিনি বহন করতে পারছিলেন না। তাই বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন; কিন্তু লাকী পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চান। লাকী খোঁজ পেলেন পে ইট ফরোয়ার্ডের। গ্রুপটি তাঁর সহায়তায় এগিয়ে আসে। লাকী এখন সাভারের গণবিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান ও সমাজকর্ম বিভাগে পড়াশোনা করছেন।
আবু বকর একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী। আবু বকরের বাবা সৌদি আরবে ভয়ানক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে দেশে ফিরে আসেন। শুরু হয় পরিবারে অভাব-অনটন। এই অনটনে আবু বকরের পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। সেই সময় আবু বকর পে ইট ফরোয়ার্ডের সন্ধান পান। জানান, নিজের আবেদন। আবু বকরের পড়াশোনা নিরাপদ হয়।